ঢাকা, রবিবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

জেরিনের মায়ায় বাধা ১১শ’ চা শ্রমিকের জীবন

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
জেরিনের মায়ায় বাধা ১১শ’ চা শ্রমিকের জীবন ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল জেরিন চা বাগান ঘুরে: নিজ হাতে চারা রোপন, এরপর সেটাকে পরিচর্যা করে বড় করা এবং সেই গাছেরই চা পাতা তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন এখানকার শ্রমিকরা। এমন ঘটনা একমাত্র ইস্পাহানি মির্জাপুর চায়ের ‘জেরিন চা’ বাগানের শ্রমিকদের দেখা গেছে।



ছোট থেকে সন্তানের মতো লালন-পালন করা চা গাছগুলো আজ বৃদ্ধের কাতারে যাচ্ছে। শ্রমিকদের বয়সের সঙ্গে চা গাছেরও বয়স বেড়েছে। সন্তানের মতো লালিত এ বাগান ছেড়ে কোথাও যেতে চান না জেরিন চা বাগানের সাড়ে ১১শ’ শ্রমিক। জেরিনের মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চান এখানকার শ্রমিকরা। জেরিন চা যেন তাদের পরিবারেই একজন সদস্য। জেরিন চা বাগানের কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই জানা গেল।

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই গ্রান্ড সুলতানের বিপরীত পাশ দিয়ে কিছু দূরে যাওয়ার পর চোখে পড়বে জেরিন চা বাগান। বাংলাদেশে চা’য়ের যাত্রা ইস্পাহানির হাত ধরেই। ইস্পাহানি মির্জাপুরেরই একটা অংশ জেরিন চা।
এই জেরিন চা বাগানে তালিকাভুক্ত মোট ১ এক হাজার ১৫০ শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে স্থায়ী কার্ডধারী শ্রমিক রয়েছে ৭৫০ জন। জেরিন শ্রমিকদের তিন দফায় ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম দফায় রয়েছে ঠিকা দফা (যারা ছুটা কাজ করেন), এরপর বস্তি দফা (যারা একটু নিয়মিত), এরপরেই রয়েছে বাগান দফা (যারা বাগানে  স্থায়ী এবং নিয়মিত) কাজ  করেন।

প্লাকিং (চা পাতা তোলা), মেনুরিং (সার দেওয়া), প্রুনিং (চা গাছ ছাটা) নির্দিষ্ট হাইটে রেখে কাটা হয়। আগাছা পরিস্কার বা উইডিং এর জন্য রয়েছে এক গ্রুপ। এর নিজ নিজ কাজ শেষে চা পাতা তোলার কাজও করতে পারেন।

মেনুরিং এর ক্ষেত্রে ১০০ কেজি সার প্রয়োগ করলে পান ৮৫ টাকা, এলপি সাইজের প্রুনিং এর ক্ষেত্রে প্রতি ১৩০টা গাছের জন্য দেওয়া হয় ৮৫ টাকা, এছাড়া ডেভেলপমেন্ট বিভাগের কর্মীদের একটা নির্দিষ্ট মজুরি  নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

 

জেরিন চা বাগানের স্থায়ী কার্ডধারী শ্রমিকদের রয়েছে বিশেষ সুবিধা। এদের প্রত্যেকেই রেশন সুবিধা পান। জেরিন চা বাগানে স্থায়ী কার্ডের সদস্যদের জনপ্রতি সপ্তাহে ৩ কেজি ২৭৫ গ্রাম চাল বা আটা দেওয়া হয়। প্রতি কেজির মূল্য ধরা হয়ে থাকে এক টাকা ৩০ পয়সা।
 
জেরিন চা বাগানে কাজ করলে এক পরিবারের একাধিক সদস্যও রেশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। এছাড়া সন্তানদের জন্য ১২ বছর পর্যন্ত রেশন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ১ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত বয়সের সন্তানের জন্য ১ কেজি ২২৫ গ্রাম, আর ৮ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত সন্তানের ক্ষেত্রে ২ কেজি ৪৪৫ গ্রাম করে চাল বা আটা দেওয়া হয়।
জেরিন চা বাগানের শ্রমিকদের কাছে এ বাগান তাদের পরিবারের সদস্য। এ বাগানের সঙ্গে তাদের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, বাগান কর্তৃপক্ষের ভালোবাসায়। এ কথা বাগানের শ্রমিকদের।
 
শুধু রেশন সুবিধাই পান তা নয়, জেরিন চা শ্রমিকদের কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা খরচ বাগান কর্তৃপক্ষই বহন করেন। এ বাগানের শ্রমিকদের সন্তানের লেখা পাড়ার জন্য একটি স্কুলও করা হয়েছে। রয়েছে তাদের চলাচলের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা। জেরিন চা শ্রমিকরা শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবহার করেন। এছাড়া নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ৪ মাসের ছুটি পান, এটাকে ৬ মাসে উন্নীত করার কথাবার্তা চলছে।
 
জেরিন চা শ্রমিক হ্যাবল (৫০) বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছোট বয়সথোন এহনে আইছি, এ বাগানোই গাছ লাগাছি, এখন পাতা তুলছি। জেরিন চা বাগানের মালিক অনেক ভালো, আমাগো রেশন দেয়, চিকিৎসার খরচ দেয়’।   মালিকের এমন সহযোগিতা অকপটে স্বীকার করে এ শ্রমিক আরও বলেন, অন্য কোথাও যাওয়ার চিন্তাও করিনা। এটাকে নিজের জায়গা মনে করি। হ্যাবলের পরিবারের আরও ৬ জন এ বাগানেই কাজ করেন।
 
তার কথার সূর ধরে জেরিন চা বাগানের শ্রমিক আলো রানী (৫৫) বলেন, আমি একেবারে ছোট বয়সে এ বাগানে চারা লাগিয়েছি। এখন সেই গাছেরই পাতা তুলছি। বাগানের প্রতি একটা মায়া হয়ে গেছে, অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। এ বাগানকে সন্তানের মতো ভালোবাসি।  

আরেক শ্রমিক রাম কিষান (৫৫) বলেন, আমি ১৯৮৫ সালে এখানে আসছি। শুরু থেকেই জেরিন চা বাগানে কাজ করছি। আমার দুই ছেলে ও আমরা স্বামী-স্ত্রী একই বাগানে কাজ করি। কোম্পানি থেকে আমাদের থাকার ঘর করে দিয়েছে। রেশন সুবিধা দিচ্ছে, ভালোই আছি।  
 
জেরিন চা বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য এখানে আধাপাকা ঘর তৈরি করে দিয়েছে।
 
জেরিন চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকরা প্রথম ২৩ কেজি পাতার মূল্য পান ৮৫ টাকা। এরপর পরবর্তী প্রতি  কেজি ৩ টাকা ৫০ পয়সা হিসেবে মূল্য ধরে মুজুরি দেওয়া হয়। রোববার সাপ্তাহিক ছুদির দিন মুজুরি দ্বিগুণ করা হয়েছে।
 
গাছে ভালো পাতা থাকলে আর আবহাওয়া ভালো থাকলে এক জন চা শ্রমিক দৈনিক ১০০ কেজি পর্যন্ত চা পাতা তুলতে পারেন বলে জানান বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক (অ্যাসিটেন্ট ম্যানেজার) মোহাম্মদ আলী।
 
শ্রীমঙ্গলে জেরিনের ৩৮৫ হেক্টর জমিতে চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে ২৬৫ হেক্টরে চা উৎপাদন হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
এসএম/এসএইচ

আরও পড়ুন...
** ‘বাংলার আমাজন’ রাতারগুল
** মেঘ-পাহাড়-ঝরনা-নদীর মুগ্ধতা পানতুমাইয়ে​
** বিছানাকা‌ন্দির জলের ওপর ‘জলপরী’
** ডু‌বে ডুবে ঘাসও খায় তারা
** ছয় মাস কৃষক, ছয় মাস বেকার
** বর্ষায় মাঝি, শুকনায় রাজমিস্ত্রি
** পানি নয়, সাতছড়ির ছড়ায় এখন শুধুই বালু
** প্রকৃতিপ্রেমিদের জন্য অনন্য সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান
** ভাড়াউড়া লেকের সৌন্দর্যে কালো মেঘ যোগাযোগ ব্যবস্থা
** লাউয়াছড়ায় ১৫ হেক্টরের মধ্যেই দর্শনার্থী সীমাবদ্ধ
** লাউয়াছড়ায় অর্থকরী ফসলের আত্মকথা
** নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন মিহির কুমার দো

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ