জৈন্তাপুর ঘুরে: রাজবাড়ি ভেঙ্গে বসেছে দোকান-পাট। বিশাল পুকুর তার শরীর হারিয়েছে বসতবাড়ির নিচে।
সকাল ৯টাতেও কোনো দোকানের ঝাঁপ খোলেনি জৈন্তাপুর বাজারে। এখনো টিকে থাকা নগ্ন দেয়ালে গুল্ম-লতার দাপট। সবুজ লনে থই থই পানি। অবহেলা-অনাদরেও মাথা তুলে গৌরবময় অতীতের সাক্ষী দিচ্ছে বিরল দর্শন মেগালিথ স্তম্ভ।
সিলেট সদর থেকে এখানকার দূরত্ব ৪১ কিলোমিটার। আর একটু পূর্ব দিকে এগোলেই ভারতের মেঘালয়। রাজবাড়ির বাঁ পাশ ঘেঁষে ভারত সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেছে তামাবিল-জাফলং সড়ক। এ সড়কের সিলেট অভিমুখে বেশ খানিকটা দূরে রানির বিশ্রামাগার এখনো অটুট রাস্তার বেড়ে।
মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ও তিব্বতীয় মাতৃতান্ত্রিক প্রথার অনুসারী এক রাজবংশ ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে এখানে। ষোড়শ’ শতকে কুচবিহারের রাজা নরনারায়ণের রাজত্বকালে তাদের স্বাধীনতা কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছিলো বটে, তবে মুঘল আমলেও স্বাধীন ছিলো তারা। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা কব্জায় নিয়ে নেয় জৈন্তাপুর রাজ্যকে।
কথিত আছে, ১৮৩২ সালে এই রাজবাড়িরই এক মন্দিরের সামনের বেদিতে প্রকাশ্যে ৩ ব্রিটিশকে বলি দিয়েছিলেন জৈন্তার রাজা। প্রতিশোধ হিসেবে ব্রিটিশরা জৈন্তা দখল করে রাজাকে মাসে মাত্র ৫০০ টাকা বৃত্তির জমিদার করে ছেড়েছিলো।
বিদ্যমান বিধ্বস্ত রাজবাড়িটি প্রাচীন রাজবাড়ির স্থানে পরে নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। দুই আমলের দুই রাজবাড়িরই ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে এখানে ওখানে। পশ্চিমে এখনো একটি মন্দিরের পরিত্যক্ত কাঠামো টিকে আছে বৃক্ষ-লতা মাথায় নিয়ে।
রাজবাড়ির ধ্বংসপ্রায় দেওয়ালের সামনে এক সারি মেগালিথ প্রস্তরস্তম্ভ। বিরাটাকার এক এক খণ্ড পাথরকে পাথরের পায়ার ওপর স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে বেদির রূপ। বেদিগুলো কোনোটা বর্গাকৃতি, কোনোটা অষ্টভূজাকার, কোনোটাবা গোল। সবচেয়ে বড় বেদিটির ব্যয় প্রায় ৩.৩৯ মিটার। সব বেদির পেছনে খাঁড়া পাথর মাটির নিচে গাঁথা। সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা প্রায় ৪.৫৪ মিটার। একটু দূরে আরো এক সারি বেদি। পাথরগুলো কোনোটা কাত, কোনোটাবা পড়েই গেছে মাটিতে।
বতর্মান ভারতের জৈন্তা পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা বেলে পাথর এগুলো। পেছনে রাজবাড়ীর এখনো টিকে থাকা শ্যাওলা জমা দেওয়ালে আাঁকা চিত্রকর্ম বুঝিয়ে দেয কি মমতা আর যত্নে গাঁথা হয়েছিলো এখানকার চুন-সুরকি।
এসব বেদি সম্পর্কে দু’ধরনের জনশ্রুতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি হলো, বেদির ওপরে বসে বিচার-আচার করতেন বিভিন্ন রাজা। সবচেয়ে বড় বেদিটিতে বসতেন রাজা। বাকি বেদিগুলো ছিলো বিভিন্ন রাজ্যের দলপতিদের জন্য নির্দিষ্ট।
অন্য জনশ্রুতি মতে, মৃত ব্যক্তিদের আত্মার সদগতির জন্য এসব পাথর প্রতিষ্ঠিত করা হতো। কোনো রাজা বা রানির মৃত্যু হলে তার নামে প্রতিষ্ঠিত হতো এক একটি বেদি। বেদির পাথরগুলো বহু ব্যবহারে মসৃণ।
জৈন্তাপুরের উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে সিলেটের কানাইঘাট ও গোলাপগঞ্জ, পূর্বেও কানাইঘাট এবং পশ্চিমে গোয়াইনঘাট ও সিলেট সদর উপজেলা।
পান-পানি-নারী, তিনে মিলে জৈন্তাপুরী- বলে একটা কথা চালু আছে সিলেট অঞ্চলে। এখানকার স্বচ্ছ পানি ও খাসিয়া পানের সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী। পর্যটকদের মুগ্ধ করে এখানকার চা বাগান আর খাসিয়া নারীর রূপ। নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতি ছিলো জৈন্তাপুরের। খুব সম্ভবত জৈন্তা শব্দটি এসেছে জাইন্তিয়া থেকে।
ধারণা করা হয়, আদি রাজমাতা টেং থেকে জাইন্তিয়ার প্রাচীন রাজবংশের উৎপত্তি। সম্ভবত জাইন্তিয়া শব্দটি খাসিয়াদের Youngteng(ইয়ংটেং) বা Youngtrai(ইয়ংট্রাই) শব্দ থেকে আসা। খাসিয়া ভাষায় ইয়ং অর্থ নিজ। আর টেং হলো কোন আদিমাতার নাম। তাই Youngteng এর অর্থ হলো-আপন ভূমি। আদি জাইন্তিয়ারা ইয়ান্তা নামেই পরিচিত ছিল।
প্রাচীনকালে জাইন্তিয়াপুরের রাজধানীকে বলা হতো ‘জাইন্তিয়া পার’। এ্ই পার অর্থ নিজ। জাইন্তিয়া পার থেকেই জাইন্তিয়াপুর, কালক্রমে জৈন্তাপুর নামটি এসেছে।
১৯৭১ সালে পাকি বাহিনী এ উপজেলায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, গণহত্যা ও লুটপাট চালায়। ১৭ এপ্রিল জঙ্গিবিমান হামলা চালিয়ে অনেক নিরীহ লোককে হত্যা করে হেমো গ্রামে। এছাড়া ৩০ জনকে হত্যা করে খান চা বাগানে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০১ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
জেডএম/
**লাউড়ের গড়ে বৃষ্টির বাগড়া
** বিশ্বের বৃহত্তম গ্রামে
** জগমোহিনীদের বিথঙ্গল আখড়ায়
** হারিয়ে যাচ্ছেন হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা
**সাত শতাব্দীর সাক্ষী শঙ্করপাশা মসজিদ
**চুন ব্যবসায়ীর ঘাট থেকে মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তরে
** চুরি গেছে মুড়ারবন্দরের শিলালিপি
**চেনা-অচেনা বন্য প্রাণীদের সঙ্গে লুকোচুরি
**বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে
** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে