বাইক্কা বিল (শ্রীমঙ্গল) ঘুরে: বাতাসের আদরে মধ্য দুপুরের রোদ তেজ হারিয়েছে হাইল হাওরে। সেই তেজহীন রোদ গায়ে মেখে পূর্বদিকপানে ঘণ্টাখানেক বৈঠা বাওয়ার পর পাওয়া গেলো বাইক্কা বিলের সীমানা।
শরীরে কচুরিপানা জড়িয়ে পানি থেকে আকাশ পানে উঠে যাওয়া কংক্রিটের স্তম্ভে লেখা ‘মাগুরা বিল’। কার্যত এমন তিনটি বিলের সমন্বয়েই এই বাইক্কা বিল। এখানে কিছু দূর পরপর লম্বা লম্বা খুঁটি গাঁড়া। সব খুঁটি মিলে ১০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে বৃত্তাকার যে জলসীমা, সেটাই বাইক্কা বিল। আর এই বিলই গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশি মাছের অভয়াশ্রম।
এতোক্ষণ হাইল হাওরে সঙ্গী ছিলো কচুরিপানার দঙ্গল। পানির ওপর ভাসছিলো ভেট-মাখনার লতা। কিন্তু বাইক্কা বিলে প্রবেশের পর পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। একটু পরপর পানিতে ভাসছে লাল আর সাদা শাপলা। বেয়াড়া বাতাসের তোড়ে পানি থেকে যেনো উড়াল দিতে চাইছে পদ্মপাতাগুলো।
এই বিলকে ২০০৩ সালে দেশি মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিরকালের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই বিলে। পানির নিচে গাছের ডাল-গুঁড়ি, কংক্রিটের স্ল্যাব ফেলে তৈরি করা হয়েছে মাছ ধরার প্রতিবন্ধকতা। বিলের চতুর্পাশের গ্রামগুলোতে সার্বক্ষণিক পাহারা বসানো হয়েছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের।
এখন বর্ষাকাল বলে পানিতে থই থই বাইক্কা বিল। তাই খুঁটির সীমারেখা ছাড়া এই বিলকে এখন হাইল হাওর থেকে আলাদা করে চেনা মুশকিল। কিন্তু শুকনো মৌসুমে আপন অবয়ব নিয়ে ফুটে ওঠে বাইক্কা বিল। বর্ষাকালের ৮/১০ ফুট পানি কমে টিকে থাকে ৩ কি ৪ ফুট। রোদের তাপে গরম হওয়া পানিতে হাঁপিয়ে ওঠা মাছগুলোর তখন আশ্রয় হয় পানির নিচে কাটা কূপে। অন্তত ১শ’ ফুট আয়তনের বেশ কিছু কূপ এখানে কাটা হয়েছে দেশি মাছগুলোর অবাধ বিচরণের জন্য।
এখন তাই নির্বিঘ্নে আইড়, কই, মেনি, ফলি, পাবদা, কানি পাবদা, ঘনিয়া, কালবাউস, রিটা, বোয়াল, চিতল, শোল, রানী, টাকি, সরপুঁটি, মলা, নামা, চান্দা, কই, তারাবাইন ইত্যাদি দেশি মাছের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে এই বিলে। বড় হয়ে পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ছে বাইক্কা বিলের এসব দেশি মাছ।
এই বিলের পানিতে আরো দৃষ্টি কাড়ে ঘাসফড়িংয়ের বিরতিহীন ওড়াউড়ি। নানা রঙ আর গন্ধের ফুল ঘিরে চলে পতঙ্গের মহড়া। বিলের এক কোণায় পানি থেকে মাথা তুলে আছে ৩১ ফুট উঁচু এক পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। পানিতে ডুবো ডুবো নলখাগড়ার ঝোপ পেরিয়ে নৌকা থেকে টাওয়ারের সিঁড়িতে পা রাখতেই অন্যরকম এক অনুভূতি। তিন তলার ওপরে উঠে তো বিস্ময়ে বিমূঢ় হওয়ার যোগাড়। ওপর তলা থেকে পুরো হাওরটাই ধরা দিয়েছে চোখে। জল ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাস যেনো নিমিষেই ঘুম পাড়িয়ে দিতে চাইছে। জামা খুলে শরীরে হাওয়া মাখার হিড়িক শুরু হয়ে গেলো তাই।
পেছনের কড়চ বনে নানা প্রজাতির পাখির মেলা। গোধূলী বেলায় হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয় ওই বন। এই টাওয়ারের আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে কালেম আর পানকৌড়ির দল।
কচুরিপানা আর পদ্মবনের ফাঁকে-ফাঁকে খেলা করে ডাহুক আর জলমোরগ। বড় ও ধূসর বকের মাছ শিকারের দৃশ্য নয়ন জুড়িয়ে দেয়। আরো দেখা যায় ভুবন চিল, শামুক খোল। আছে কোরানে বর্ণিত পাখি আবাবিলও। এখানে আপন মনে জলে ভেসে বেড়ায় ডুবুরি, বালি হাঁস আর ছোট সরালির দল।
দেশি পাখির মধ্যে আরো রয়েছে কানি বক, গো বক, ধুপনি বক, রাঙা বক, জলপিপি, নেউপিপি, পান মুরগি, শঙ্খচিল, পালাসী, কুড়া ঈগল, দাগি ঘাসপাখি, বাংলা শকুন, পাতি চ্যাগা ইত্যাদি।
আর শীতের অতিথি হয়ে এ বিলে আরো আসে কালো মাথা কাস্তেচরা, রাজসরালী, গেওয়ালা বাটান, মেটেমাথা টিটি, কালাপঙ্খ ঠেঙ্গী, ধলা বালিহাঁস, মরচেরং, ভূতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, গুটি ঈগল ইত্যাদি পাখি।
সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করার পর এই বিলে পাখির সংখ্যাও বেড়েছে আগের চেয়ে। দেশি ও অতিথি পাখির গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ২০১১ সালে রিঙ পরানো হয়েছে ১৪ প্রজাতির দেশি ও ১৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির পায়ে। হালে বড়ঠুঁটি নলফুটকি, উদয় নলফুটকি, বৈকাল ঝাড়ফুটকি ও সাইক্সের ফুটকি নামে নতুন ৪ প্রজাতির পাখিও মিলেছে বাইক্কা বিলে। তবে বেগুনি বক এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৬
জেডএম/জেএম