ঢাকা, রবিবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

অটো রিকশাতেই পাহাড় পেরিয়ে বান্দরবান

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৬
অটো রিকশাতেই পাহাড় পেরিয়ে বান্দরবান

কাপ্তাই ঘুরে: শেষ অবধি স্বর্গের রাস্তায় মামাদের দেখা মিললো না। এই মামা মানে হাতি।

পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙ্গিয়ে হাতিরা আসে এই স্বর্গের রাস্তায়। কখনো রাস্তা পাড়ি দিয়ে আর এক পাহাড়ে চলে যায়। কখনোবা রাস্তা ধরেই হাঁটাচলা করে বুনো হাতির দল।

এদিকটায় বসতি নেই বললেই চলে। পাহাড়ের মাথায় কাশ ফুল ফুটে জানান দিচ্ছে শরতের। অনেকটা নিরুপদ্রবেই আাসা গেলো কাপ্তাই শহরে।
এই কাপ্তাই নামকরণে কত্থয় ও কিয়ং শব্দ দু’টির প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা প্রচলিত আছে। স্থানীয় ভাষা কত্থয় অর্থ কোমর, আর কিয়ং অর্থ খাল। ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করা হলে এই কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনাতেই স্থাপন করা হয় সদর দপ্তর। সে হিসেবে কাপ্তাই আর চন্দ্রঘোনা পার্বত্য এলাকার অতি প্রাচীন শহর।

এর উত্তরে কাউখালি ও রাঙামাটি, পূর্বে বিলাইছড়ি, পশ্চিমে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া আর দক্ষিণে বান্দরবান। এই কাপ্তাইয়েই কর্ণফুলী নদীতে দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র আর চন্দ্রঘোনায় উপমহাদেশের বৃহত্তম কাগজ কল কর্ণফুলী পেপার মিলস। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ১১ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তত ৭টির বসবাস এই কাপ্তাইয়ে। মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, চাকমা, মুরং, খিয়ং ও পাংখোয়া ছাড়াও বাংলা ভাষাভাষীদের বসবাস এ উপজেলায়। এখানে আছে চা বাগান ও জাতীয় উদ্যান।  

বাঁয়ে ঘুরে চট্টগ্রাম সড়ক ধরে ছুটলো অটো রিকশা। আরো কিছু দূর এগুতেই হাতের বাঁয়ে পড়লো কর্ণফুলী নদী। এ নদীর এ পাড়ে কাপ্তাই-চট্টগ্রাম সড়ক, ওপাড়ে উঁচু উঁচু পাহাড় সারি। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের একাংশ দেখা গেলো রাস্তা থেকেই। নদীর পাড়ে একটু পর পর পর‌্যটন স্পট গড়ে রাখা। তবে বৃষ্টিভেজা দুপুরে কোনো পর‌্যটক চোখে পড়লো না।

নদীর ওপাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় সারির মাথায় চুপটি করে বসে আছে মেঘের দল। রাম পাহাড় আর সীতার পাহাড়েও মেঘের দাপট। মায়াবন স্কাউট্ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ওপাশে পাহাড়ের মাথায়ও জেঁকে বসে আছে মেঘ।

রাস্তার দু’পাশে সারি সারি রেশম গাছ। রাঙামাটিতে স্থাপিত রেশম বোর্ডের বেশ কিছু কাজ থাকার কথা এদিকটায়।


রেশম আর আগর গাছের সারি ফেলে একটানে চন্দ্রঘোনা ঘাটে এসেই চক্ষু চড়কগাছ। ফেরিতে ওঠার পন্টুনটা পানির নিচে। সংযোগ সড়কে কোমর সমান পানি। পাঁচ/ছয় জনে ধরাধরি করে ফেরিতে তুলছে মোটর সাইকেল। ফেরি থেকে ডাঙ্গায় উঠতে গিয়ে পানিতে নেমে আটকে যাচ্ছে অটো রিকশা। কোনো ক্রমে আজদাহা শরীর নিয়ে একটা ট্রাক উঠলো ফেরিতে। যাত্রীরা উঠলো নৌকায় করে।

এই কর্ণফুলীর জন্ম ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়ে। রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার থেগা নদীর মোহনা বা ঠেগামুখ থেকে বড় হরিণার মুখ পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকায় ভারত-বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ করেছে এই কর্ণফুলীই।

কোনো এক সময় এক আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমে পড়েছিলেন আরাকানের রাজকন্যা। কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে তারা নৌবিহারে বেরিয়েছিলেন কর্ণফুলীর বুকে। জলের বুকে চাঁদের প্রতিফলন দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন রাজকন্যা। একটু বেসামাল হতে পানিতে পড়ে গিয়েছিলো তার কানে গোঁজা ফুল। ফুল উদ্ধারে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন রাজকন্য। প্রবল স্রোত রাজকন্যাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো দূরে। শোকে কাতর রাজপুত্রও আত্মাহুতি দিয়েছিলেন কর্ণফুলীরই বুকে। সেই ‌আত্মাহুতির করুণ কাহিনী থেকেই নদীটির নাম কর্ণফুলী। মারমা আদিবাসীদের কাছে যার নাম কান্সা খিওং।
এই কর্ণফুলীকে নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেন- ওগো ও কর্ণফুলী/ তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি/ তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী, কে জানে/ সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে।

৪৫ কিলোমিটার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আসা অটোরিকশা বিদায় নিয়েছে চন্দ্রঘোনা ঘাটে। কর্ণফুলী পার হয়ে আর একটা অটোরিকশা ছুটলো বান্দরবান অভিমুখে। আরো ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হবে এই অটো রিকশাতেই।

এতক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। বৃষ্টি থাকলেও মুখ গোমড়া করে আছে আকাশটা। রাজস্থলী আর রোয়াংছড়ি পেরিয়ে বান্দরবান শহর চিরে প্রবাহিত সাঙ্গুর তীরে আসতে আসতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।

সাঙ্গু ব্রিজের কাছে উঠে এসেছে পাহাড়ি ঢলের পানি। অথচ শুকনো মৌসুমে এই ব্রিজ থেকে সাঙ্গুল প্রবাহটাকে কতো নিচেই না মনে হয়। শুকনো মৌসুমের ১ মিটার গভীরতা বেড়ে এখন ১৫ মিটার হয়েছে। এখন সেকেন্ডে অন্তত আড়াই হাজার ঘনফুট পানি বই্ছে সাঙ্গুর বুকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৬
জেডএম/

**
স্বর্গের রাস্তায় পাহাড় পাড়ি!      
** আলুটিলার রহস্যগুহায় অন্ধকারে একচক্কর                                                             
      

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ