ঢাকা, রবিবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

‘মহুয়া বনে লুটিয়ে পড়ে মাতাল চাঁদের হাসি লো’

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৬
‘মহুয়া বনে লুটিয়ে পড়ে মাতাল চাঁদের হাসি লো’ ছবি: আসিফ আজিজ

বান্দরবান থেকে: তোমরা কে কে পার্বত্য এলাকায় যোগদান করতে চাও-কমিশনারের এ আহবানে হাত তুলে সম্মতি জানিয়েছিলেন কেবল হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ।

সতীর্থরা তখন তাকে নিয়ে শঙ্কিত।

তারা বললেন-তোমার মাথা খারাপ নাকি! জেনে শুনে কেউ কি আগুনে পা দেয়? তুমি কি করতে যাচ্ছো জান?

কিন্তু সেদিনের অটল মুজাহিদ এখনো তার সিদ্ধান্তকে সঠিকই মনে করেন। সেই সিদ্ধান্তের কারণেই বান্দরবানে এসে অনেক ভালো কিছুর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন বলে মনে করেন তিনি?

যদিও অনেক কাল ধরেই সমতলের মানুষের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পোস্টিং শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিলো। এখন পরিস্থিতি কিছুটা বদলালেও যোগাযোগ আর দূরত্বের কারণে স্বেচ্ছায় এখানে খুব কম সরকারি কর্মকর্তাই আসতে চান।

তাহলে আপনার বেলায় বান্দরবানে আসার পেছনে ঠিক কোন ভাবনা কাজ করেছিলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে আল মুজাহিদ বলেন, প্রথমত, আমি চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করি। দ্বিতীয়ত, তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (আলেফ উদ্দিন) স্যারের বক্তব্য আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, জীবনে কিছু করতে হলে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। চ্যালেঞ্জ ছাড়া ভালো কিছু করা যায় না। পার্বত্য এলাকায় তেমনি ভালো কিছু করার সুযোগ রয়েছে। তোমরা কে কে যোগদান করতে চাও, তারা হাত উঠাও।  

ট্রেনিং সেশন শেষে আমরা গিয়েছিলাম শিক্ষা সফরে। ফেরার পথে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুপারভাইজার যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুপ্রাণিত করেছে।

আল মুজাহিদ এর জন্ম জামালপুর সদরে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে যোগ দিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংকে। পরে ব্যাংক ছেড়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।

২০১৩ সালে উত্থিত তার সাহসী হাত প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়। যার ফলশ্রুতিতে বান্দরবান জেলার এনডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। যোগদানের পর থেকে উদ্যমী-উদ্ভাবনী চিন্তার নজির গড়তে সক্ষম হন তিনি।

তার হাতের ছোঁয়ায় বিরাণ ভূমিতে গড়ে উঠেছে সুদৃশ্য পর্যটন স্পট, ধুধু মাঠ ভরপুর হয়েছে বৃক্ষরাজিতে। আবার কোথাও পরিত্যক্ত ঘর হয়ে উঠেছে মনোরম রেস্ট হাউস।

সোমবার যখন প্রান্তিক লেকে যাই, ঠিক তখন একটি ট্যুরিস্ট দল প্রান্তিক ঘুরে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের দেখে বললেন, আপনারা কি লেকে নৌকা ভ্রমণ করেছেন। জবাব এলো না। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, নৌকা ভ্রমণ করেন, অনেক মজা লাগবে।

জানা গেলো, প্রান্তিক লেক জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ফ্রি নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে নৌকায় আপনি দাঁড় টেনে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াতে পারবেন।

চড়া রোদের মধ্যেই আমাদের নৌকা ঘুরতে আমন্ত্রণ জানালেন। আমরাও লুফে নিলাম। নিজেই নৌকার দাঁড় টেনে ঘুরে দেখালেন পাহাড় কোলের প্রান্তিক লেক। নৌকা বাইতে বাইতে গানও গাইলেন সুর করে।

প্রান্তিক লেককে তিনি মনের মাধুরি দিয়ে সাজাতে চান। যার গোড়া পত্তন অনেক আগেই শুরু হয়েছে।

তিনি বললেন, এখানে জাতীয় কবি নজরুলের, ‘মহুয়া বনে লুটিয়ে পড়ে মাতাল চাঁদের হাসি’র চিত্রায়ন করা হয়েছে।

মেইন ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমে পড়বে তাল-তমাল বন। তার পরেই থাকছে মহুয়া বন। টিলার ঢালুতে থাকছে মহুয়া বাগান। গা ঘেঁষে থাকবে বাহারী রকমের দেশীয় ফুলের বাহার। থাকছে কংক্রিটের আয়েসী চেয়ারে হেলান দিয়ে মাতাল চাঁদের হাসি উপভোগ করার ব্যবস্থা। মাতাল চাঁদের হাসির সঙ্গে থাকছে মাতাল ফুলের গন্ধও। এ জন্য গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কামিনী-হাসনাহেনা-শিউলী-মালতীরা।

প্রান্তিক লেকের মাধ্যমে বেঁচে থাকবে প্রকৃতি-প্রাণী-লতাগুল্ম। ‘ওই ডাকে জুইশাখে ফুলখুকি ছুটরে’ কবিতার মতো সাজবে। আমাদের শিশুরা যেন অ্যাকুরিয়াম নির্ভর না হয় এমন ভাবনা ব্যক্ত করেন এই এনডিসি।

এক সময় বাংলার প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল হরেক রকম গাছ-পালা। যা অনেক এখন বিলুপ্তির পথে। সেই সব হারিয়ে যাওয়া লতাগুল্মের সমাহার রয়েছে এখানে। নতুন প্রজন্মের কাছে সমৃদ্ধ অতীতকে তুলে ধরার পাশাপাশি নগরের যান্ত্রিক জীবনে প্রাকৃতিক পরশে জুড়িয়ে দেওয়ার সব প্রয়াস রয়েছে এখানে।

শিশুরা এখানে এলে স্বচক্ষে দেখে যাবে বিভিন্ন জাতের দেশীয় গাছ ও পশু পাখি। জানতে পারবে বাংলার সোনালী অতীত।

তার কথার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া গেলো প্রান্তিক লেক ঘুরে। ৬৮ একর এলাকা জুড়ে পাহাড় বেষ্টিত ২৫ একরের বিশাল জলরাশি। যাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কবিয়াল ভাবনার সোনালী অতীত।

বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরত্ব। এখানে শিক্ষা সফর ও পিকনিকের জন্য সব আয়োজন রাখা হয়েছে। রয়েছে মাটির তৈরি উন্মুক্ত মঞ্চ। সামনে রয়েছে কয়েকশ’ লোকের বসার মতো মাঠ। শব্দ ও পরিবেশ দূষণ মুক্ত এখানে রয়েছে শুধু হরেক রকম পাখির কলকাকলি।

এক শ্রেণির লোক রয়েছে যারা মনে করেন- দেশটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে কারো খুব বেশি অবদান নেই। তাদের সঙ্গে দ্বি-মত পোষণ করতেই হয় এখানে এলে।

সবুজে ঢাকা বান্দরবানকে নিবিড় ঘন করে তুলছে জেলা প্রশাসন। প্রতি বছরই হাজার হাজার বৃক্ষ রোপন করছেন। যার অগ্রভাগে রয়েছেন জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বনিক। আর তার প্রধান সিপাহসালার এনডিসি হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ।

তাদের আন্তরিক ছোঁয়ায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে নীলাচল, চিম্বুক পাহাড়, মেঘলা পর্যটন স্পট। সম্প্রসারণ করা হচ্ছে নতুন নতুন এলাকায়। আগে যারা ঘুরে গেছেন তারাই ফের এলে নতুন রূপে বিমোহিত করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৬
এসআই/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ