সাজেক, বাঘাইছড়ি, রাঙামাটি ঘুরে: খাগড়াছড়ি শহর থেকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালি। আঁকা-বাকা, উঁচু-নিচু, সর্পিল, আকাশছোঁয়া সড়ক।
বাহন অটোরিকশাটা উঁচুতে ওঠার সময় যতো গতি নিচ্ছিল, নামার সময় যেন তার চেয়ে বেশি গতিতে নামতে থাকলো, রাস্তার পরের অংশটা যে আরও উঁচু, সেই উঁচুপথ মাড়ানোর জন্য যে আগে থেকেই গতি বাড়াতে হবে। এরমধ্যেই কোথাও ইংরেজি ‘U’ , কোথাও ‘S’ আকৃতির বাঁক।
সড়কটা যে সত্যিই ভয়ের তার নজির সাজেক যাওয়ার দিনই মিললো। আকাবাঁকা বাঁকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়ায় পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাস ও বাঁশবোঝাই ট্রাক। তাতে প্রাণ ঝরে এক দুর্ভাগা পর্যটকের। গুরুতর আহত হন ওই মাইক্রোবাসের আরও ১২ পর্যটক এবং ট্রাকের হেলপার ও চালক। এই বন্ধুর-ভয়ানক পথেই চাঁদের গাড়িতে (খোলা জিপ) হেলপারের কাজ করে রমেশ। ভালো নাম বাবুরাম ত্রিপুরা। বয়স ১৪ বছর। রমেশের কথা, পাহাড়ে বেড়ে উঠেছে বলে এই বয়সেও এই সড়কে কাজ করতে ভয় করে না তার।
উঁচু-নিচু সড়কে অনেকটা ‘বাধ্য’ গতির কারণে যেখানে গাড়ির ভেতরে থেকেই শরীর নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় না, সেখানে হেলপারের জায়গায় আর কতটুকুই নির্ভয়ে থাকা যায়? মুখে ভয় করে না বললেও রমেশের কথায় আসে অদৃষ্টের দায়ে সে এ পথে নেমেছে।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেক রুটের চাঁদের গাড়ির হেলপার রমেশের বাড়ি মহালছড়ির যৌথ খামার এলাকায়। তারা ৫ ভাই ৪ বোন। সে সর্বকনিষ্ঠ। বাবা গত হয়েছেন বছর কয়েক আগে। মা চালাচ্ছেন পরিবার।
সপ্তম শ্রেণিতে উঠে আর পড়াশোনা হয়নি রমেশের। তার পড়শী-বন্ধুরা চালিয়ে যাচ্ছে ‘বড়’ হওয়ার পাঠ। অভাবের তাড়নায় সে-ই ছিটকে পড়েছে কেবল। পরিবারের অভাবটা ঘোচাতেই বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়ের কোলে দুরন্তপনার দিন শেষ হয়ে গেছে তার। সাজেক থেকে খাগড়াছড়ি শহরে ফেরার পথে বাহন যখন সেনাবাহিনীর এসকর্টের অপেক্ষায়, তখন রমেশের চাঁদের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে।
রমেশ বলছিলো, “আমার অনেক বন্ধু-প্রতিবেশী স্কুলে যায়, আমি যাইতে পারি না। বাড়িতে টাকা লাগবে। সে কারণে এই গাড়িতে কাজ নিছি। ”
ভয় করে না এ সড়কে চলতে? রমেশ বলে, “পাহাড়ে বড় হইছি। পাহাড়রে ভয় করে না?” সাজেকের দুর্ঘটনার খবর শুনেছো? জিজ্ঞেস করলে এই কিশোরের নিরুৎসাহী উত্তর, “আগেও এমন হইছে। ”
প্রচলিত বিধান অনুযায়ী রমেশ শিশু। শিশুশ্রমই যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে রমেশ হেলপারের কাজ করছে সাজেকের মতো সর্পিল ভয়ানক সড়কে। কেবল হেলপারের কাজই নয়, রমেশ এই আকা-বাঁকা সড়কে গাড়ি চালানোও শিখেছে। বলছিলো সে-ই, “পড়াশোনা হয় নাই, এখন গাড়ি চালাইতে পারি। বড় হইলে গাড়িতেই থাকতে হইবো। ”
খাগড়াছড়ি জেলা জিপ মালিক সমিতির চার্ট অনুযায়ী, শহর থেকে সাজেকে চাঁদের গাড়ি দিনে এসে দিনে ফেরত যাওয়ার ভাড়া ৪ হাজার ৬০০ টাকা, আর রাত যাপন করলে ৬ হাজার ৬০০ টাকা। এই ভাড়া থেকে রমেশ পায় ৫শ’ টাকা।
এই রুটে রমেশের মতোই আরও বেশ ক’জন কিশোর হেলপার আছে। তাদের সবারও পারিশ্রমিক ঠিক একইরকম।
সাজেকের মতো অনেক এলাকায়পর্যটন স্পট গড়ে ওঠায় দিন বদলাচ্ছে পাহাড়ি জনপদের। কিন্তু এই দিন বদলের গল্পেও যোগ দিতে পারছে না রমেশরা, হয়তো তার ভাষ্যমতোই, ‘কপালের কারণে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৬
এইচএ/জেডএম
আরও পড়ুন
** ঘুম ভাঙালো মেঘ
** কেওক্রাডংয়ের চূড়া থেকে সূর্যোদয় দর্শন! (ভিডিও)
** কেওক্রাডংয়ের রাতের আকাশের কতো বিশালতা!
** কেওক্রাডংয়ের দুর্গম পথে প্রশান্তির চিংড়ি
** বগালেকে ফ্রি ফিশ স্পা!
** মুরংদের তুলার কম্বল, টেকে ২শ’ বছর
** আত্মশুদ্ধির আহ্বানে আকাশে শতো ফানুস
** মেঘ ফুঁড়ে পাহাড়ের গায়ে রোদ বাতি!
** জলের ওপর বসতভিটে
** হ্রদের জলে কার ছায়া গো!
** সড়ক যেন আকাশছোঁয়ার খেলায় (ভিডিও)
** সাজেকের ভাঁজে ভাঁজে প্রকৃতির সাজ
** মানিকছড়ির ফুলের ঝাড়ুতে পরিচ্ছন্ন সারাদেশ
** নট ইউজিং ‘ইউজ মি’