ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বিশ্বাসে ভরা দীঘি সম্ভাবনায় ঠাসা

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬
বিশ্বাসে ভরা দীঘি সম্ভাবনায় ঠাসা আবু বকর/ ছবি- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর

বাগেরহাট থেকে: প্রায় দু’শ’ একর জুড়ে বিশাল দীঘি। স্বচ্ছ জলরাশির চারদিকে ২০ ফুট উচু বাঁধ। দেখতে খানিকটা বেড়িবাঁধের মতো। মাটির বাঁধের বাইরে ঘিরে রয়েছে পায়ে হাঁটার পথ।

পথের কিছু অংশ মেঠো, কিছুটা ইট বিছানো। শুধু পশ্চিম দিকের অংশটি পিচঢালা।

এদিকটায় প্রশস্ততাও কিছুটা বেশি। প্রায় ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তার মতো। আর এই রাস্তা, মাটির বাঁধ ঘন সবুজে ঢাকা। বাঁধের ফাঁকে ফাঁকে অল্প ক’টি বাড়ি।

দীঘিটি পুরোপুরি বর্গাকৃতির। একপাড় থেকে আরেকপাড় দৃশ্যমান তবে স্পষ্ট নয়। উত্তরে বাঁধানো ঘাট সোজা উঠে গেছে খানজাহানের সমাধিতে। ঝকঝকে তকতকে সেই ঘাটে শতশত পূণ্যার্থী গোসল করছেন। যদিও ঘাটে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে পুকুরে ভয়ঙ্কর কুমির রয়েছে। গোসল করা থেকে বিরত থাকুন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

ছোট ছোট শিশুরা এমনকি নারীরাও বাদ যাননি। কেউ আবার পানি বোতলে ভরে নিচ্ছেন। একজন প্লেটে করে খিঁচুড়ি এনে পুকুরে ভাসিয়ে দিলেন। অনেকে আবার ওজু করে মাজারের দিকে পা মাড়াচ্ছেন। বেশ কিছু প্রেমিক যুগলকে দেখা গেলো তীরে বসে আড্ডায় মেতেছেন।

ওপরে মাজারে দেদারছে চলছে তাবিজ, মোমবাতি, আগরবাতি বিক্রি। আবার ‍মুরগিও বেচাকেনা হতে দেখা গেলো। মাজারের ঠিক প্রবেশদ্বারের মুখে জ্যান্ত মুরগি কিনে সিন্নি হিসেবে দিয়ে যাচ্ছেন ভক্তরা। আবার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছেন শিক্ষা সফরে। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন মানত করে। অনেক রকম মিথ রয়েছে এই দীঘি নিয়ে। কারো কারো না-কি বিভিন্ন রোগ সেরে গেছে এই ঐতিহাসিক পুকুরের পানি পান করে, কারোবা গোসল করে।

মাজার ও বিশাল এই পুকুরটি দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত-দর্শনার্থী হাজির হচ্ছেন এই চত্বরে। তাদের সেই পদচারণা উত্তর পাড়েই সীমাবদ্ধ। বিশাল এলাকায় পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনা থাকলেও তাকে কাজে লাগানোর বিন্দুমাত্র উদ্যোগ এখানে নেই।

পথের কিছু অংশ মেঠো, কিছুটা ইট বিছানো।  শুধু পশ্চিম দিকের অংশটি পিচঢালা।  এদিকটায় প্রশস্ততাও কিছুটা বেশি।  প্রায় ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তা |মানুষ আসছেন আর সান বাঁধানো ঘাট দেখেই ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু সামান্য একটু পরিকল্পনা নিলেই এই মাজার ও পুকুর পর্যটনের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে। যা থেকে আয় হতে পারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও।

আকরাম হোসেন নামে এক দর্শনার্থী এসেছেন ঢাকা থেকে। তিনি বলেন, সরকার পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করেছে। কিন্তু ঘোষণার বাইরে খুব একটা উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ঘোষণা দিয়েই দায় শেষ।

তিনি মনে করেন, এই পুকুরটি ঘিরে একটু পরিকল্পনা মাফিক প্রকল্প নেওয়া গেলে দারুণ কিছু হতে পারে। তার মতে, চারদিকে তীর ঘে‍ঁষে এমনকি বাঁধেও চেয়ার পেতে দেওয়া যেতে পারে। যেখানে মানুষ বসে বিশ্রাম নিতে পারবে। আর চারদিকের যে ওয়াকওয়ে রয়েছে তার পাশে যদি ফুলের গাছ লাগিয়ে দেওয়া যায় তাহলে চেহারাই বদলে যাবে।

অনেকেই আসবেন এই দীঘির পাড়ে হেঁটে নির্মল বাতাস উপভোগ করার জন্য। আবার প্রধান সড়ক থেকে খানিকটা ভেতরে হওয়ায় শব্দ দূষণও নেই। সে কারণে নির্জনতা উপভোগ করার জন্য দর্শনার্থীরা এখানে ভিড় করবেন। পাশেই রয়েছে নয় গম্বুজ ও এক গম্বুজ মসজিদ। সেগুলোতেও রয়েছে দর্শনার্থী ও গবেষকদের ব্যাপক আগ্রহ।

বাংলানিউজএছাড়া পুকুরের স্বচ্ছ পানি এক ধরনের ভাসমান শ্যাওলায় ঢেকে গেছে। সেই শ্যাওলা সরিয়ে যদি নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলেতো কথাই নেই! মানুষ দল বেঁধে এখানে আসবেন নৌকা ভ্রমণ উপভোগ করতে। এর বিশালতা এতো ব্যাপক একসঙ্গে যদি শতাধিক নৌকাও ছাড়া হয় তবুও কোনো বিভ্রাট ঘটবে না।

পর্যটকের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমন দখলদারদের হাত থেকেও রক্ষা পাবে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি। বেড়িবাঁধে কিছুদিন আগেও তেমন একটা ঘরবাড়ি ছিলো না। কিন্তু দিন দিন বাড়ছে বাড়ির সংখ্যা।

খান জাহান (র.) সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। যারাই বলছেন সবটাই মিথ হিসেবে দাবি করছেন। কোনো অকাট্য যুক্তি কিংবা দালিলিক কোনো প্রমাণ উদ্ধার হয়নি। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর একটি উদ্যোগ নিলেও তা একটি রিটের কারণে আটকে গেছে।

বাংলানিউজযতদূর জানা যায়, প্রায় ছয়শ’ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় মিঠা পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিশাল এই দীঘিটি। আধ্যাত্মিক সাধক ধর্মপ্রচারক ও সমর নায়ক হযরত খানজাহান আলী খনন করার পর যাতে কেউ দীঘির সুপেয় পানি নষ্ট করতে না পারে সেজন্য দীঘিতে এক জোড়া মিঠা পানির কুমির ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই থেকেই বংশ পরম্পরায় খানজাহান আলী দরগাহ দীঘিতে এই মিঠা পানির কুমির বসবাস করে আসছে।

বর্তমানে পুরাতন আমলের একটি পুরুষ কুমিরসহ ২০০৫ সালে ২৪ জুন ভারতের মাদ্রাজ থেকে আনা চারটি মিঠা পানির কুমিরের তিনটি এই দীঘিতে রয়েছে। খানজাহান আলী দরগাহ’র কুমিরের রয়েছে দীর্ঘ কিংবদন্তীর ইতিহাস।

খানজাহান আলীর সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনও অজানা। মিথ অনুযায়ী, ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনাবাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্মজীবন আরম্ভ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ এ মাত্র ২৬/২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্নর) পদে যোগ দেন। পরবর্তীতে দুই লাখ সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলে রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাদুরিয়াতে আশ্রয় নেন।

১৪১৮ খৃষ্টাব্দে খানজাহান যশোরের বারো বাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার আরম্ভ করেন। হযরত খানজাহান আলী (র.) অক্টোবর ২৫, ১৪৫৯ তারিখে (মাজারশরীফের শিলালিপি অনুযায়ী ৮৬৩ হিজরী ২৬ শে জিলহজ) ষাট গম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজ রত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে এখানেই সমাহিত করা হয়।

সহযোগিতায়
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬
এসআই/জেডএস/এটি

আরও পড়ুন

**বাগেরহাট ডিসির কষ্ট ও বাস্তবতা
** চিত্রায় প্লেনের ছোঁয়া

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ