সুন্দরবন থেকে: পশুর নদী থেকে বাঁয়ে বেঁকে গেলো গাঙচিলের নাক। শ্যালা নদীতে ঢুকতেই একটা ঢোল আকৃতির মোড়চ।
ডানের সরু খালটার পলিজমা পাড়ে মাঝেমধ্যেই রোদ পোহাতে আসে নোনা পানির শিকারী কুমির। ওখান থেকে ক’দিন আগেও একটা আস্ত মহিষ গেছে কুমিরের পেটে। ইরাবতী ডলফিনেরও নাকি ভারি পছন্দ জায়গাটা।
ওই খাল বেয়ে একটু ভেতরে চাঁদপাই রেঞ্জের স্টেশন অফিস। খুলনা বা মংলা থেকে পশুর নদী বেয়ে এলে সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি ওখান থেকেই নিতে হয়। কিন্তু শ্যালার বুকে এখন ভাটির টান। তারওপর পন্টুনও নেই। তাই ফরেস্ট অফিসে যাওয়া বা আসায় জন্য নৌকা থেকে নামলেই হাঁটু কাদা। সকালের রোদে হাসতে থাকা চিকচিকে পলি মেখে সুন্দরবনের সঙ্গে প্রেমটা বুঝি জমতে শুরু করলো এখান থেকেই। খালের একটু বাঁ পাড়ে সহোদর দুই জলদস্যু জুলফু আর মর্তোজার বাড়িটা দেখালেন গাঙচিলের মাস্টার ইউনূস। সঙ্গে এও জানালেন, ক্রসফায়ারে ওদের মৃত্যুর পর খুব শান্তিতে আছে জয়মনির মানুষ। বাড়িটার পেছনে আজদাহা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাইলো গুদাম। নদীর এক পাশে ক’দিন আগে আগুনে পুড়ে যাওয়া ট্যুরিস্ট জাহাজ পেলিকন ভাসছে।
সেই ওয়েল ট্যাংকার ডুবির পর শ্যালা নদীতে যাত্রী আর মালবাহী কার্গো চলাচল বন্ধ আছে বটে, কিন্তু ট্যুরিস্ট বোট প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নেই কোনো। এখানকার মানুষের মুখে মুখে এখনো ফেরে ফেটে যাওয়া ট্যাংকারের ক্রুড ওয়েল তুলে চড়া দামে বিক্রির গল্প।
বনবিভাগের অনুমতি পাওয়ার পর জয়মনির ঢোল থেকে বেরিয়ে ফের পশুরের কোর্স ধরলো গাঙচিল। পেছনে পড়ে রইলো করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্র। রূপসা আর মংলার মোহনা থেকে শুরু হয়ে বঙ্গোপসাগর পানে ছুটে চলা পশুরেও এখন ভাটিতে ছুটছে পানি। ১১০ হর্স পাওয়ারের লঞ্চটা তাই ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারছে।
৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ পশুরের উভয় পাড়ে ৪২৫ কিলোমিটার অববাহিকার অধিকাংশ জুড়েই সুন্দরবন, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। পশুরের পূর্ব পাড়ে যেনো গায়ে গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরী গাছের সারি। শরণখোলার দিক থেকে সুপতি খাল হয়ে সুন্দরবনে ঢুকলে এতো সুন্দরী চোখে পড়ে না বটে, তবে বিশ্বের বৃহত্তম এ বনের আর এক আইকন গোলপাতার আধিক্য আছে ওদিকটায়।
এখানে দিনের দ্বিতীয় প্রহরে সূর্যটা ঝুলে আছে ঠিক সুন্দরী বৃক্ষসারির মাথার ওপর। খালের পাড়ে সুন্দরীদের ছায়ায় তাই কিছুটা আঁধারের ছোপ। এই সুন্দরীই তো হার্ডবোর্ড তৈরির প্রধান কাঁচামাল। সেগুলোর পায়ের নিচে আছড়ে পড়ছে লঞ্চের ধাক্কায় তীর পানে ছুটে যাওয়া ঢেউ।
পশুরের গভীরতা ৫০ ফুটেরও ওপরে বলে বোম্বে থেকে গম নিয়ে আসা একটা জাহাজ এসে নোঙর ফেলেছে এতোটা উজানেও। তা থেকে মাল খালাসের জন্য ভিড় করেছে বেশ ক’টি লাইটারেজ। জাহাজের হিসেবে বড়টাই এমভি বা মাদার ভেসেল। কিন্তু হাউক নামের এই জাহাজটায় লেখা নেই সেটা। তবে ছোট ছোট লাইটারেজগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই এমভি লেখা দেখা গেলো। এমন হাস্যকর কম্বিনেশনে হাসির রোল পড়লো মাস্টার ব্রিজের সামনে।
হাউককে পেরিয়ে পশুরের পশ্চিম তীরে লঞ্চ ভিড়লো হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে। মংলা বা খুলনা থেকে এক দিনের ট্যুরে সুন্দরবনে বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের ভিড় এখানটায়। জেটির গোড়াতেই মেলা বসেছে বানরের। পর্যটকদের সঙ্গে যেনো মস্করা শুরু করলো সব ক’টা। কিন্তু বনের ভেতর থেকে গদাই লস্করি চালে ধাড়ি একটা বানর বেরিয়ে আসতেই চুপ মেরে গেলো সব ক’টা। তবে পর্যটকদের ছুঁড়ে দেওয়া মুড়ি আর বাদাম খাওয়ার সময় গুমোট ভাবটা আর রইলো না। সব ক’টা এবার মিলেমিশেই খুঁটে খুঁটে খাবার খেতে শুরু করেছে।
একটু এগুতেই বনরক্ষীদের কোয়ার্টারের পাশে ছোট্ট একটা খাঁড়ি। কাঠের সেতু পেরিয়ে ওপাশে যেতেই সুন্দরবনের স্পট আবহ ফুটে উঠলো। দু’পাশে গোলপাতা গাছ। ছোট ছোট শ্বাসমূল। সোয়াম্প ফরেস্টের চরিত্র এখানে বেশ ভালোভাবেই ফুটে আছে।
সামনেই বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সম্মানে একটা মিষ্টি পানির পুকুর কেটেছে বনবিভাগ। সেটার বুক জুড়ে শত শত লাল শাপলা হাসছে। পুকুরের ঠিক মাঝখানে কাঠের খুঁটির ওপর একটা গোলঘর। এখানে বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের দু’দণ্ড তিষ্ঠোনোর মোক্ষম জায়গা বটে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য গড়া কাঠের গ্যাঙওয়েটা ভাঙ্গা। তাই শাপলা বিলের মাঝখানে যাওয়ার আশা ত্যাগ করে সামনে এগুতেই ঊর্দ্ধমুখী শ্বাসমুলের ফাঁকে ক্রমাগত পানি ছাড়তে থাকা স্যাঁতস্যাঁতে মাটির কয়েক ফুট ওপরে কাঠের প্লাটফর্ম। তার ওপর দিয়ে নাক বরাবর সোজা এগিয়ে গেছে কয়েকশ’ মিটার।
গাছের ছায়ায় ছায়ায় দুপদাড় শব্দ তুলে ওয়াকওয়ে মাড়িয়ে মাথায় পৌঁছুতেই ডানে বাঁক। আর একটা খালকে বাঁয়ে রেখে এগুতে শুরু করতেই খালপাড়ে রইলো গেওয়া গাছের সারি, বিপরীতে হাতের ডানে সুন্দরী। সামনে এবার ফের ডানে বেঁকে গেছে গ্যাঙওয়েটা। এবার গাছের মগডালে বানরের খেলা শুরু হলো হঠাৎ। এতোক্ষণ ধরে হরিণের পায়ের ছাপ আর কাঁকড়ার গর্ত চোখে পড়েছে ঢের, জলের টিকটিকিও চোখে পড়লো কয়েকটা, কিন্তু এবার বাঘ মামার পায়ের ছাপে হুমড়ি খাওয়ার দশা। একটা নয়, একাধিক। সম্ভবত কোনো মা বাঘ বাচ্চা নিয়ে হেঁটে গেছে এদিকটা দিয়ে। পাশে আর একটা ছোট পায়ের সারি ফুটে আছে কাদায় জমা পানিত।
আর একটু এগুতেই ওয়াকওয়ের শেষ প্রান্তে তিন তলা সমান উঁচু এক ওয়াচ টাওয়ার। কিন্তু আশপাশের গাছগুলোর মাথা এই টাওয়ারটাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সুন্দরবনের টপ ভিউ দেখা তাই সম্ভব হলো না এখান থেকে। তবে পুরো পথটাতে পুরো সুন্দরবনের একটা মিনি সংস্করণ অবশ্য পাওয়া গেলো। আয়তাকার ট্রেইলটার শেষ বাহুতে ইট বিছানো পথটা অবশ্য মাটি তুলে প্রায় ঢেঁকে দিয়েছে সুন্দরবনের পোকা কাঁকড়ার দল।
হাড়বাড়িয়া থেকে বেরুনোর মুখে দেখা গেলো, গাছের ডালে আয়েসে বসে ছানা বানরের পিঠ চুলকে আদর করছে মা।
আরো পড়ুন...
** দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
জেডএম/