দুবলার চর (সুন্দরবন) থেকে: অতিরিক্ত মাছের নেশাটা প্রায়শই কাল হয়ে ওঠে তাদের জীবনে। গভীর সাগরে নিম্নচাপ শুরু হলে অগভীর পানির দিকে ছুটতে শুরু করে মাছের দল।
কিন্তু আরও বেশি মাছ পেয়ে মাছের লোভ বাড়তেই থাকে মনে। এক খ্যাপ দুই খ্যাপ করে বাড়তেই থাকে জাল পাতার পর্ব। কানের কাছে এসে বিপদ সাইরেন বাজাতে থাকা তুফানের শব্দটাও কানে ঢোকে না তখন।
এভাবেই গত মাসের ঝড়ো হওয়ায় প্রাণ গেছে তিন সাগরজীবী জেলের। আরও তিনজন ভেসে গেছেন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। সম্প্রতি তাদের বেঁচে থাকার খবর এসেছে দুবলায়।
সুন্দরবনের জেলেদ্বীপ দুবলার চরে বসে সে গল্প বলছিলেন উপকূলীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শহীদ মল্লিক। চরের কানার মাথায় রামপালের নাসিম মল্লিকের দোকানে তখন সাগরজীবীদের আড্ডা জমেছে। সে আড্ডায় আরও শামিল ইফতেখার, আবু হাসান শেখ, নিরাপদ বিশ্বাস।
আড্ডার কথায় আঁড়ি পাততেই যেনো জোয়ারে ভেসে দোকানটার অনেক কাছে চলে এসেছে সাগর। ঢেউ আছড়ে পড়ার ছন্দোবন্ধ শব্দের রেশ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে সাগরজীবীদের এই আড্ডাকেও। নিরাপদ বাবুদের যেনো জানিয়ে যাচ্ছে, যেকোনো সময়ই তোমাদের বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারি আমি।
এরই মধ্যে বিকেলে ভাটায় সাগরে ছুটে গেছে জেলের দল। ফিরতে ফিরতে ফের আগামীকাল রাতের জোয়ার। এই জোয়ার-ভাটার সঙ্গেই জীবনবাঁধা এ দ্বীপের ছয় হাজারেরও বেশি মাছ শিকারীর। তাদের ঘীরে আরও হাজার দশেক মৌসুমী সাগরজীবী। তাদের জীবন ও জীবিকার পদে পদে চাঁদের প্রভাব। কোনো ধরনের যন্ত্র ছাড়াই চাঁদের অবস্থান, বাতাসের গতি, স্রোতের ধরন আর মাছের আচরণ দেখে আকাশ ও আবহাওয়ার মতি ঠিক ঠিক বুঝে নেন তারা।
তাদের জন্য ভরা কটালে মাছ উথলায় সাগরে। পূর্ণিমা আর অবাবস্যায় ধরা পড়ে সবচেয়ে বেশি মাছ। কিন্তু মরা কটালে শুরু হয় মাছের আকাল। সাগরের অনেক গভীরে সরে যায় মাছের দল। তাদের ভাষায় তাই খুশি নামে ভরা গোনে। মরা গোনে মাছ পাওয়া যায় কম।
প্রতি অমাবস্যার পর শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী-একাদশী পর্যন্ত তাই বন্ধ থাকে মাছ ধরা। একইভাবে পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষেরও ওই ছয়-সাত দিন জাল গুটিয়ে অলস সময় কাটান তারা।
আর একটা রাত গড়ালেই শুরু হবে কৃষ্ণপক্ষের ষষ্ঠী। কাল থেকে তাই এক সপ্তাহের ছুটিতে যাচ্ছে জেলের দল। রাত দ্বিতীয় প্রহরে গড়ানোর মুখে মাছ ভর্তি নৌকা নিয়ে দ্বীপে ফিরতে শুরু করেছেন তারা।
ওদিকে নিউমার্কেট নামে পরিচিত দুবলার প্রধান বাজারে শিববাবুর বাজারের পেছনে বসেছে নাম কীর্তণ ও ভাব সঙ্গীতের আসর। এদিকে কানার মাথার সামনের খালটায় নোঙর ফেলেছে ট্যুরিস্ট বোটগুলো। আর বালির উপরে পাতা চৌকিতে জেলে নেতাদের আড্ডায় জমতে শুরু করেছে তাদের জীবনের গল্প।
উৎপাত কমে গেলেও এখনও বনদস্যুই তাদের জীবিকার প্রধান শত্রু। তাদের হাতে জিম্মি হওয়া মানেই মুক্তিপণ। আর মুক্তিপণ বিনিময়ের মাঝের সময়টায় অসহায়ের মতো অত্যাচারের শিকার হওয়া। যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে কিছু কমেছে বনদস্যুর সংখা। আর দৌরাত্ম্য কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে সমিতি করে গড়া একতা।
এখন মহাজনরাও সহজে ঠকিয়ে দিতে পারেন না তাদের। এই সমিতির ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে এখন আর জোর করে কেউ জলের দরে মাছ বিক্রিতে বাধ্য করতে পারে না জেলেদের। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে পাঁচ মাস এখানে মাছ ধরেন তারা, তাতে মৌসুম শেষে প্রতি জেলে দেড় থেকে দু’লাখ টাকা নিয়ে ফিরতে পারেন ঘরে।
কিছু মাছ তারা শুঁটকি করেন রোদে শুকিয়ে। আর কিছু মাছ বিক্রি করে দেন কাঁচাই। ছুরি, লইট্যা আর চিংড়ির শুঁটকিই বেশি করেন তারা। আর রূপচাঁদা সাধারণত কাঁচাই বিক্রি করেন। অক্টোবরের শেষ নাগাদ এসে ২৮ ফেব্রুয়ারির পর অস্থায়ী ঘরগুলো খুলে নৌকায় করে দ্বীপ ছাড়েন তারা। দীর্ঘ বরষা শেষে ফের ফিরে আসেন সাত মাস পর। বরষাকালে ফুলে ওঠা সাগরের বেড়ে ছোট হয়ে আসা এ দ্বীপে আসেন কেবল ইলিশ ধরার জেলেরা।
** দুবলার সৈকতে মৃতদের মিছিল!
** সাগরের বুকে ভাসমান রাত
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
** দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর, ২০১৬
জেডএম/জিপি/এসএনএস