খুলনা ঘুরে: ঝুলে পড়ছে মরিচা ধরা টিন, জঙ ধরা তালা লাগানো দরজার একাংশ নেই, যন্ত্রগুলো পড়ে আছে অকেজো হয়ে। খোলা জায়গায় অসংখ্য বুনো গাছের সঙ্গে ঝোপ-ঝাড়।
না, কোনো জঙ্গলবাড়ি বা পুরোনো বাড়িও নয়, খুলনার ভৈরব নদের তীরে খালিশপুর অবস্থিত দেশের প্রথম ও একমাত্র হার্ডবোর্ড মিলস লিমিটেডের দৈন্যদশা এটি। শোনা গেল, অর্থ সংকটের কারণে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে মিলটি বন্ধ হয়ে আছে। হার্ডবোর্ড মিলে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে প্রথমে কাউকে চোখে পড়ে না, রাজ্যের নীরবতা এখানে। আর গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ করা। গেটে টোকা দিলে একজন নিরাপত্তা প্রহরী বের হয়ে আসেন। সীমাহীন বিরক্ত নিয়ে কোথায় যাবেন বলে জিজ্ঞাসাসূচক বাক্য ছুঁড়ে দেন।
সাংবাদিক পরিচয় জেনে মুখ উজ্জ্বল করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। পুরো মিলের জায়গাটা যেন একটি পরিত্যক্ত ভবন। প্রবেশপথের রাস্তাটি ছাড়া সব জায়গা ঝোপ-জঙ্গলে ভরা। অগণিত গাছ আপনা-আপনি জন্মে তরতর করে বেড়ে উঠছে। এক সময় এ জায়গাটা ছিলো কর্মচারীদের হাঁটাচলা ও কাঁজের ফাঁকে আড্ডার স্থান। মিলের পুরো এলাকা ঘুরে নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া চত্বরে দ্বিতীয় কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া গেলে না। বোর্ড তৈরির মেশিন, গোডাইন, ফিনিশিং কারখানা, বয়লারসহ মিলের প্রতিটি যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। স্থবির হয়ে পড়ে থাকা মিলের মেশিনগুলো। তবে এগুলো দেখে বোঝা যায়, একটা সময় ঘরঘর ঘরঘর শব্দ করে তৈরি করেছে লাখে লাখে বোর্ড। যা সারাদেশের সব ধরনের বোর্ডের চাহিদা পূরণ করতো।
প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকে ডান পাশে ভৈরব নদের জলধারা, অবিরাম গতিতে চলছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। এই ঘাট দিয়ে এক সময় সুন্দরবন থেকে নৌকা-জাহাজবোঝাই সুন্দরী গাছের কাঠ এনে হার্ডবোর্ড তৈরির কাজে ব্যবহার করা হতো। পাশে নদের মূল ঘাট থাকার পরও কেবল হার্ডবোর্ড মিলের কাজের জন্য এই ঘাটটি বানানো হয়ছে। মিলের মূল ভবন যেন নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তেমনি ঘাটটিতেও এসেছে স্থবিরতা।
ঘাটের পাশেই মিলের ‘চিপার মেশিন’। কয়েক বছর আগেও সেখানে কাঠ দিয়ে ঘরঘর ঘরঘর আওয়াজ করে একের পর এক হার্ডবোর্ড তৈরি হতো। ১৯৬৫ সালে প্রায় ১০ একর জমির ওপর কানাডিয়ান কমার্শিয়াল করপোরেশন খুলনা হার্ডবোর্ড মিলটি স্থাপন করে। এরপর টানা বহুদিন সুনামের সঙ্গে চলে মিলটি।
বন্ধ হওয়ার প্রথম ধাক্কাটা আসে ২০০২ সালে। পরে সরকারি সিদ্ধান্তে ২০০৫ সালে আবার চালু হয়। কিন্তু ২০১২ সালে এসে অর্থ সংকটে পড়ে মিলটি আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লুৎফুর রহমানই এ কথা জানান। তার কথা বলার সময় গলার স্বরে ছিলো অতীত সুখস্মৃতি। প্রায় ১৫ বছর ধরে এই মিলে কাজ করতো লতিফ। একসময় মালের অর্ডার দেওয়া, কাঠ আনা নেওয়াসহ কর্মব্যস্ততা ছিলো মিলটিতে। এই মিলের রেলের বোর্ড ছিলো বেশ জনপ্রিয়। রেলের বোর্ডের অর্ডার এলে দম ফেলার ফুরসতও ছিলো না কর্মচারীদের। মিলটি চালু থাকার সময় এলাকা ও ভৈরব নদও ছিলো জমজমাট।
মিলের ৩শ’ শ্রমিকর মধ্যে যারা মাস্টার রোলে চাকরি করতেন, তাদের অনেকেই এখন বেকার জীবন-যাপন করছেন, স্থায়ী চাকরিজীবীরা অনেকেই বিভিন্ন স্থানে চলে গেছেন। প্রাণহীন মিলটি থেকে বের হয়ে আসার সময় দেখা হলো কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে। তাদেরও দাবি, ফের চালু হোক , আবার প্রাণবন্ত ও কর্মব্যস্ত হয়ে উঠুক দেশের প্রথম ও একমাত্র খুলনা হার্ডবোর্ড মিলস।
আরও পড়ুন...
** সন্ধ্যাটা কাটুক রূপসা সেতুর বর্ণিল আলোয়!
** খুলনার স্পন্দন রুপসার ঘাট!
** হিম শীতে ডাকাতিয়া বিলে
** বাগেরহাটের পালপাড়ার বাসনকোসন সারাদেশে
** সপ্তদশ শতকের বিস্ময় ‘অযোধ্যা মঠ’
** ‘এখানে বড়-ছোট নাই, যাই করেন দশ টাকা’!
** বিমানবন্দর রেলস্টেশনে অকেজো মাইক!
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৬
এমসি/এইচএ/