ঐতিহ্যের শহর খুলনা থেকে ভোর ৬টায় যাত্রা শুরু করে শিরোমনি বাজারে পৌঁছলাম সাড়ে ৬টায়। কিন্তু শিরোমনি থেকে ভাঙা-চোরা ইটের রাস্তা দিয়ে ডাকাতিয়া পাড়ায় এলাম সোয়া ৭টায়।
কাঁচা রাস্তাটির শেষ মাথায় আসতেই দেখা মিলল জনাকয় লোকের। তারা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। এ সময় আমাদের দেখে অবাক হয়ে আমরা কোথায় যাব জানতে চাইলেন। ডাকাতিয়া বিল দেখতে চাই বলেতেই, হাসতে শুরু করলেন। এ সময় তাদের একজন বললো, এত সকালে বিল কি দেখবেন?
এরপর সামনে হাঁটতে শুরু করার পর দেখা গেলো একটি খাল। দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছোট (ডিঙ্গি) নৌকা। কথা বলে জানা গেলো খালটির নাম ডাকাতিয়া। এই খালের পশ্চিম পাশের আইল দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর হাঁটতেই আইলের ঘাসে জমে থাকা শিশিরে আমাদের জুতা ভিজে গেলো।
ভিজল আমাদের প্যান্ট ও পাজামাও। আরেকটু সামনে এগুতেই দেখা মিললো সূর্যের। কাটতে শূরু করলো কুয়াশাও। মিলতে শুরু করলো কর্মমুখী মানুষেরও দেখা।
কথা হলো শিশির কুমার মণ্ডল নামের এক মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাকে বললাম, বিলটির নাম ডাকাতিয়া বিল রাখা হলো কেন? জবাবে তিনি বললেন, আমাদের ঠিক উত্তর-পশ্চিমে (এখন কলা, পেয়ারাসহ বিভিন্ন গাছের বাগান) ডাকাতরা ডাকাতি করতো, এখানেই থাকতো।
আগে এই জায়গায় নদী ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, নদীতে আসা যাওয়া মানুষের মালামাল ডাকাতি করে নিতো ডাকাতরা। এ কারণে এই এলাকাকে ডাকাতপাড়া এবং এই বিলকে ডাকাতিয়া বিল নামে ডাকা হয়। একই কথা জানান গ্রামের একাধিক বাসিন্দাও।
সামনে এগিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে ডিঙি নৌকা চালিয়ে দেখা গেল, বিলের ভেতর থেকে জেলেরা বের হচ্ছে। প্রত্যেক জেলের হাতেই ছোট্ট একটা বৈঠা। বৈঠা হাতে মাছের ব্যাগ নিয়ে আসছেন। জেলের পাশাপাশি রাতভর ঘের পাহারা দিয়ে বাড়ি ফিরছেন ঘের মালিকরাও।
এরপর মাছের ঘেরের জন্য দেওয়া আইল দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সকাল ৯টা পর্যন্ত দেড় থেকে ২ মাইল হাঁটলাম। স্ত্রীকে নৌকায় উঠিয়ে কাজে যাচ্ছিলেন প্রশান্ত মণ্ডল। তার স্ত্রী জানালেন, বিলটির কোনো নির্ধারিত সীমা নেই। শেখ আব্দুর রউফের স্ত্রী হাসিনা বললেন, খালি চোখে যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় ততদূর।
এই সময় জেলেদের টাকায় নৌকায় চড়ে ডাকাতিয়া বিলটি দেখানোর জন্য অনুরোধ করা হলেও কেউ অনুরোধ রাখলো না। একজন মাছ ব্যবসায়ীর মনটা সামান্য নরম হলো। তিনি আমাদের ডাকাতিয়ার খালটির অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে হঠাৎ বললেন, আর সামনে যাবো না, আপনারা নামেন।
আমরাও মনে কষ্ট নিয়ে নৌকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। ঘড়িতে তখন সময় সকাল সাড়ে ৯টা। এমন সময় ২জন মাছ ব্যবসায়ী (জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে বাজারে বিক্রি করেন) মাছ নিয়ে আসছেন। তিনশ থেকে চারশ হাত দূরে থাকতেই পিছনের ব্যবসায়ীকে মাছের খাঁচা থেকে কী যেন লুকাতে দেখা গেলো।
নৌকাটি ঘাটে ভেড়ানোর পরপরই দ্রুত সামনে এসে বললাম, দাদা আজ মাছ পাইছেন কেমন? জবাবে ব্যবসায়ী বললেন, বেশি হয়নি।
এরপর বললাম, আপনার খাঁচায় মাছ কিন্তু ব্যাগে কি?
একটু নরম সুরে জবাব দিলেন তিনি, পাখি। আমি দেখতে পারি? বলতেই, প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে ডাহুক ও কাউন নামের পাখি বের করলেন। আবারো প্রশ্ন করি তাকে, বিক্রি করবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। কাউন ৪০০ আর ডুনকা (ডাহুক) ২০০ টাকা।
কথা বলে জানতে পারলাম এই মাছ ব্যবসায়ীর নাম নিত্যানন্দ মণ্ডল। ডাকাতিয়াপাড়ার স্কুলের সামনে বাড়ি তার। তিনি মাছের পাশাপাশি এই পাখি দুটি শিরোমনি বাজারে বিক্রি করবেন।
নিত্যানন্দ মণ্ডল বলেন, বাড়ি গিয়ে পার্টির কাছে ফোন করবো। তারপর শিরোমনি বাজারে নিয়ে গেলেই তারা এসে নিয়ে যাবে। কত টাকা হলে বিক্রি করবেন। উত্তরে তিনি বললেন, একদাম ৬০০ টাকা। বাজারে নিলেই ৮০০ টাকা বিক্রি হবে।
একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, জেলেরা পাখি শিকার করতে বিলের দাম ও আগাছায় কল (ফাঁদ) পেতে আশপাশেই অপেক্ষা করেন। রাতে খাবারের জন্য রেব হওয়া পাখিগুলো এখানে এসই ধরা পড়ে। শুধু ডাকাতিয়া গ্রামের ৩০ থেকে ৪০জন মাছ ব্যবসায়ী আছেন। এরা এই দুই প্রকার পাখি ছাড়াও কাম, বাঁকসুর, আলপিনসিহ দেশি বিদেশি পাখি ধরে নিয়মিত বাজারে বিক্রি করেন।
তারপর সুজন গায়েনের নৌকায় চড়ে বিলের ভেতরে প্রবেশ করি। যতোই ভেতরে যাওয়া, ততোই কুয়াশা জেঁকে বসে, সঙ্গে শীত। সূর্য হাজার চেষ্টা করেও তার উত্তাপ ছড়াতে পারে না। বিলজুড়ে শারিপা, গো-শালিক, শালিক, চড়ই, পানকৌড়ি, বকসহ অতিথি পাখিদের ওড়াউড়ি, কিচির মিচির শব্দ শোনা গেলো। বাংলাদেশ সময়: ০৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬
এমএফআই/জেএম