গাবুরা (সুন্দরবন) ঘুরে: সুন্দরবনের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। লোনা পানির খোলপেটুয়া আর কপোতাক্ষ নদীবেষ্টিত সাতক্ষীরার শ্যামনগরের এই ইউনিয়নের জীবনযাত্রা সংগ্রামী ছিল হয়তো, কিন্তু ছিল না মিঠাপানির কোনো অভাব।
কিন্তু ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা তাণ্ডব চালিয়ে সব এলোমেলো করে দিয়েছে এখানকার জীবনযাত্রা। মিঠেপানির পুকুরগুলোকে প্লাবিত করে ঢুকিয়ে দিয়েছে লোনা পানি। যেসব জমিতে চাষবাস হতো, নষ্ট করে দিয়ে গেছে সেসবও। কেবল লোনা পানির চিংড়ির ঘের ছাড়া আর কিছুই স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে পারেনি গাবুরায়।
সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জের নীলডুমুর ঘাট থেকে খোলপেটুয়া পাড়ি দিয়ে চাঁদনীমুখা ঘাট। সেখানে নেমে চাঁদনীমুখা বাজারে লোকজনের সঙ্গে খানিক আলাপ সেরে কিংবদন্তি বাঘ শিকারী পচাব্দী গাজীর বাড়ির উদ্দেশে মোটরসাইকেলে চেপে যাত্রা। প্রত্যন্ত অঞ্চল বলতে যা বোঝায়, তারই প্রমাণ দিচ্ছিল এখানকার মাটি বা কাঠের বেড়ার ওপর গোলপাতা বা টিনের চালার বাড়িগুলো। রাস্তার এক পাশে লোনা পানির খাল, আরেক পাশে চিংড়ির ঘের। মোটরসাইকেল থামলো পচাব্দী গাজীর সরা গ্রামের বাড়িতে। ১৯৯৭ সালে প্রয়াত পচাব্দীর বাঘ শিকারের লোমহর্ষক গল্প শুনতে তার সন্তানদের এ বাড়িতে আসা। মাটির মেঝে, কাঠের বেড়া আর টিনের চালের ঘর। বেড়া এবং চাল বেশ পুরনো বোঝাই যায়।
পূর্বমুখী এ ঘরের বারান্দাসমেত মাটির ঢেলার পাশেই দরোজার দু’দিকে তিনটি মাটির পাত্র। গোলাকৃতির এই পাত্রগুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘মেটে’ বলা হয়। ধানের গোলার মতো এই মেটে মূলত ধান রাখার জন্য ব্যবহার হওয়ার কথা থাকলেও গাবুরাসহ আইলা বিধ্বস্ত অঞ্চলে এখন ব্যবহার হচ্ছে পানি রাখার পাত্র হিসেবে। টিনের চাল থেকে পানি যেখানটায় গড়িয়ে পড়ে ঠিক সেখানে রাখা হয়েছে এই মেটে। পাঁচভাগের একভাগ মাটির নিচে গেড়ে রাখা, বাকি চারভাগ ওপরে। ঢাকনা হিসেবে রয়েছে টিনের প্লেট। পচাব্দী গাজীর বাঘ শিকারের গল্প সেরেই তার ভাতিজা ঈমান আলী গাজী জানান, গাবুরায় এখন মিঠেপানির জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষ। ওপাড়ের নীলডুমুর থেকেও আনতে হয় পানি। এই অভাবের মধ্যে মানুষ এখন মেটে ব্যবহার করছে পানি ধরার জন্য। বৃষ্টি হলে এখানে জমা হয় পানি। প্রকল্প বা নীলডুমুর থেকে যে পানি আসে, তার পাশাপাশি খাবারের জন্য এ পানির ওপর নির্ভর করতে হয়।
শীতে বৃষ্টি কম হলেও বাড়িগুলোতে এই মেটে ‘পজিশন’ দিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে ‘ভাগ্যে’র ওপর ছেড়ে।
পচাব্দী গাজীর বাড়িতে যে তিনটি মেটে রয়েছে, এরমধ্যে একটি দরোজার বাম পাশে, আর দু’টি ডান পাশে। ডান পাশের দু’টির একটি বেশ বড়, এই ‘মেটে’তে দেড়শ’ লিটার পানি ধরবে, অন্যটাতেও একশ’ ২০ লিটারের কম ধরবে না। বাঁ পাশেরটাও একই আকৃতির। বোঝা গেল, পানি একবার ধরা গেলে বেশ ক’দিনই খাওয়া যাবে। ঈমান আলী গাজীর সঙ্গে কথা বলার সময় উঠোনে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন পড়শী আবুল কাশেম। তিনি বলেন, “এই মেটে মাটি দিয়ে গড়া হলেও এতে সিমেন্টের প্রলেপ আছে। যখন কেবল ধান রাখার জন্য ব্যবহার হতো, তখন একেকটির দাম ৩০-৪০ টাকা ছিল। কিন্তু আইলার পর এই অঞ্চলে মেটের দাম হু হু করে বেড়ে দাঁড়িয়েছে শ’ থেকে দেড়শ’ টাকা। ”
আবুল কাশেম জানান, প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই আছে এ ধরনের ‘মেটে’। কেউ শীতের সময় ঘরে তুলে রেখেছেন হয়তো, কেউ এই বাড়ির মতোই একেবারে গেড়ে রেখেছেন।
ঈমান আলী গাজী বলেন, “আগে আমরা পুষ্কুনির (পুকুর) পানি খেতাম, এত মেটে-মুটে লাগতো না। আইলার পর এখন পানি ধরা লাগে। মেটে ব্যবসায়ীরাও সেই সুযোগে ব্যবসা করে যাচ্ছে। ”।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
এইচএ/এএ/
আরও পড়ুন
** প্রথম সুন্দরবন যাত্রায় শুশুকের অভ্যর্থনা
** ফুলতলার গামছাশিল্প বাঁচাবে কে!
**ফুলতলার দেশসেরা গামছা
**সবচেয়ে বড় এক গম্বুজের মসজিদ বাগেরহাটে
**বাগেরহাটে মধ্যযুগীয় সড়কের পথ ধরে
**ফের জাগছে খান জাহানের খলিফাতাবাদ নগর!
**শতভাগ বৃক্ষশোভিত বেতাগার সবুজছায়
**রিয়েলাইজেশন অব ডিজিটালাইজেশন