বছরজুড়ে দেশ ঘুরে অবশেষে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে যখন পৌছলাম তখন দিগন্ত থেকে শেষ কুয়াশার রেখাটুকুও মুছে গেছে। দৃশ্যপটে যা দেখা যাচ্ছে তা গেরস্থ বাড়ির হেসেলঘর থেকে উৎসারিত ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
সে পাই আর না-ই পাই, ভোরের প্রথম আলোটি কিন্তু একই রঙ ছড়ায়, একই আশা জাগায় প্রেম, প্রকৃতি ও জীবনে। তাইতো জীবনও ছুটে চলে অবিরাম গতিতে। জীবন কখনো সূর্যের অপেক্ষা করেনা। সূর্য ওঠার আগেই যে কৃষক অথবা ঘের শ্রমিক আধো আলো-ছায়াতে জীবনের জন্য ছুটে চলে সূর্য তার অনুসারিমাত্র। অন্ধকারকে জয় করে যে সেইতো আলো।
যশোর থেকে শ্যামনগরের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছি সেই ভোর সাড়ে পাঁচটায়। রাস্তার দুধারে খেজুরের গাছ থেকে রসের হাড়িগুলো অনেক আগেই নেমে গেছে। বাশের কঞ্চি থেকে তখনো চুইয়ে চুইয়ে ফোটা ফোটা রস ঝড়ছে। সেই ফোটা ফোটা রসে ঠোট ভিজিয়ে নিচ্ছে কখনো কাক, কখনো শালিক অথবা টুনটুনি। সারাদিন শুকনো খাবার খেতে হবে তাই বুঝি একটু গলা ভিজিয়ে নেয়া আর কি!
আকাবাকা পথে চলতে গিয়েই চোখে পড়লো কখনো দূরের মাঠা, সবুজ ঘাস অথবা প্রাচীন বটের ঝুড়ি। চুকনগরের পথ ধরে আরো একটু সামনের দিকে আগাতেই চোখে পড়লো সাতক্ষীরার ঐতিহ্য আর দেশের সম্পদ-ছোট বড় মাছের ঘের। একটার সাথে আরেকটা লাগানো। মাঝে শুধু ব্যবধানকারী আইল। তার ওপর কয়েকটি খেজুর গাছ।
সড়কের পাশের বিস্তৃত অধিকাংশ ঘেরেই চিংড়ি চাষ হয়। এ জেলায় প্রায় ৫৫ হাজার চিংড়ি ঘের আছে। বেশির ভাগ ঘেরেই বাগদা চিংড়ি চাষ হয়। অন্যান্য মাছও চাষ হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানীকৃত শতকরা ৭০ভাগ চিংড়িই সাতক্ষীরায় উৎপাদিত হয়।
এরকম অসংখ্য ঘেরের ওপারে চোখে দেখি অবারিত সবুজ প্রান্তর। একটু পরপর মাটির ঘর, শাপলার বিল অথবা পদ্ম পুকুর। শুষ্ককায় ধুলিসূসরিত গ্রামের একটু পর পর দেখতে পেলাম ফাটা ফাটা শুষ্ক মাঠ ও কচুরিপানার পুকুর।
যশোরের যশ খেজুরের রস। একইভাবে বৃহত্তর যশোরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে খেজুর গাছ- যা সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তৃত। একসময় দেশের প্রতিটি জেলা, পাড়া বা গ্রামে ছিল খেজুরে গাছ। প্রতিটি বাড়িতে দুই-তিনটি খেজুর গাছতো ছিলই। আজ তা প্রায় বিলিন হতে চলেছে। বাংলার এ এতিহ্যটুকু যশোরই যা ধরে রেখেছে।
মাছের ঘেরের ওপর সাড়িসাড়ি খেজুর গাছের ওপর দিয়ে দিনের প্রথম সূর্য যখন উকি দিল আর রাতের শেষ বাদুরটি যখন ঘরে ফিরলো তখন ঘের শ্রমিক সিকান্দার আলী অথবা রজব আলী হয়তো তার অর্ধেক কাজ শেষ করে একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রায় সব ঘেরেই দেখলাম কোনো না কোনো শ্রমিক কাজ করছেন। সকালের নিয়মিত যত্ন-আত্মি করে তারা কেউ হয়তো ঘরে ফিরবে।
সাতক্ষীরার পথে পথে তেমন ফসলের মাঠ চোখে পড়েনি। যশোরে যেমন সরিষা, ফুলকপি অথবা বিভিন্ন ফুলের বাণিজ্যক চাষ চোখে পড়েছে তেমনটি সাতক্ষীরার পথে পথে চোখে পড়েনি। বাস্তার দু ধারে জঙ্গলি গাছের ফাকে ফাকেই রয়েছে পরজীবী সোনালী লতা, ধুতরার ফুল, বিচ্ছিন্ন কলা গাছ, মাঝারি তুত গাছ অথবা মাঝে মাঝে শীতের সবজী ক্ষেত। কচুরিপানার মজা পুকুরও কম দেখিনি।
শ্যামনগরের অনেক পুকুর ও জলাশয়ে চোখে পড়েছে ডাহুক। তবে রাস্তায় দ্রুত চলমান গাড়ি থেকে অর্ধ-ডুবন্ত ডাহুকের দেখা মেলেনি। মাছের ঘেরে সাদা বকের আনাগোনার কমতি ছিলনা। মাছরাঙা পাখির অস্থির ছোটাছুটি আর নি:সঙ্গ চিলের নিরলস বিচরণ সবই চোখে পড়বে শ্যামনগরের পথে পথে। গেরস্থের উঠানে হাস, মুরগী, তিতির আর কবুতরের ছোটাছুটিতো আছেই। সেই সাথে হঠাৎ সবুজ ক্ষেতের মাঝে লাল জামা পড়া মুন্ডা বালিকার কাকতাড়ুয়া বনে যাওয়ার দৃশ্যও এড়িয়ে যায়নি।
আসলে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরন্তন বাঙালি এতিহ্য ও সংস্কৃতি। জীবনের রূপও বদলেছে। জীবিকার টানে জীবন এখন ধূসরবরণ, শেকর থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। শহরের অট্টালিকার ভিড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে ভোরের কুয়াশা, বিকেলের গোধুলি। এখানে নদী নেই, নেই ঝড়াপাতা, দুর্বা ঘাস, শিশুদের চড়ুইভাতি আরো কত কি! কিন্তু তারপরও সব মিলিয়ে যায়নি, হারিয়ে যায়নি সবটা। আছে সমুদ্রের গর্জন, দুইটি ফুল একটি কুড়ি, পাহাড়ের ওপারে মেঘ বালিকার বিচরণ অথবা আকা-বাকা নদীর তীর ঘেষে সুন্দরীদের সবুজ আঁচল বিছিয়ে নিরন্তর অভিসার। বছরজুড়ে দেশ ঘুরে সেই সুন্দরকেই খুঁজে ফিরি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
এএএফ/এসএইচ