স্বামী তো গেছেই, এক দেবরও খোরাক হয়েছে বাদাবনের বাঘের। তার শ্বশুর বাসুদেব মন্ডল দুই ছেলেকে বাঘে খাওয়ার দুই ঘটনারই সাক্ষী।
নিজের খাবারটা নিজেকেই জোগাড় করতে হয় কমলাকে। টাকার অভাবে ক্লাস টেনে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি ছেলে বাদলের। কনকনে শীতের ভেতর ভোর রাত থেকে পানিতে কুচা ধরে এসেও অতিথি আপ্যায়নে কি সাবলীল কমলা।
আর এক বাঘ বিধবা সীতা রাণীর স্বামীকেও বাঘে নিয়েছে বছর সাতেক হলো। কি কারণে কে জানে, হাসি যেনো উপচে পড়ছে তার। তবে ওটা যে স্বাভাবিক হাসি নয় তা বুঝতে সময় লাগে না বেশী। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড় করতে এখন দিনরাত অমানবিক খাটুনি দিতে হয় তাকেও। তাদের মতো বাঘ বিধবারা তো নিজেদের সমাজেরই চক্ষুশুল। কারো স্বামীকে বাঘে নিলে অবহেলার অমানিশা নেমে আসে তার জীবনে। ফুটতে থাকে দোষারোপের ফুলঝুরি। যে পর্বের শুরু হয় স্বামী বনে যাওয়ার শুরু থেকেই। ওই মুহূর্ত থেকেই প্রতিক্ষণের জন্যই বাঘের কবল থেকে স্বামীকে রক্ষার প্রার্থনা করতে হয এদের।
স্বামী যতো দিন বনে থাকে, ততোদিনই আলগা মাথায় চলাফেরা বারণ এদের। বন্ধ রাখতে হয় শরীরে সাবান ঘষা। রান্নার জন্য মরিচ পোড়াতে পারে না তখন। সব ধরনের ভাজা পোড়া বন্ধ রাখতে হয়। এমনকি চাল বা ডাল ভাজিও করতে পারে না জেলে বধূরা।
এরপরও কারো স্বামীকে বাঘে নিলে ধরে নেওয়া হয়, তার স্ত্রীর হয়তো ব্রত পালনে কোথাও গাফিলতি হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর তাই অথৈ জলে হাবুডুবু খেতে থাকে বাঘ বিধবারা। জেলে সমাজে তাদের বলা হয় অপয়া। স্কুলে ছেলেমেয়েদের দেখা হয় অবহেলার চোখে। গোটা জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে বাঘ বিধবাদের।
কেবল শ্যামনগরেই এমন বাঘ বিধবার সংখ্যা কয়েকশ’। পানখালী চুনা জেলেপাড়ায় ৩৫ ঘরের মধ্যে ৩ জন আছেন বাঘ বিধবা। অনতিদূরের এক জেলেপাড়ায় তো এক নারীর স্বামীকে দু’দুবার বাঘে খেয়েছে। এদের সহায়তার জন্য সরকারের উদ্যোগ থাকলেও তা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তের হাত পর্যন্ত পৌছায় কমই। যাদের মাধ্যমে এই সহায়তা বিতরণের কথা, তারাই দালাল দিয়ে বাঘ বিধবাদের টাকা মেরে দেন। আর কিছু টাকা ফিরে যায় বাঘ বিধবারা কি করবেন তা বলতে না পারায়।
নিজের খাবার নিজেদেরই যোগাড় করতে হয় বাধ বিধবাদের। বাঁচতে হয় প্রতিবেশীদের করুণার পাত্র হয়ে। ঘরের দাওয়ায় বসে কমলা রাণী যখন তার কষ্টের গল্প শোনাচ্ছিলেন তখন ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে ছিলেন তার শ্বশুর বাসুদেব। চোখের সামনে দুই ছেলেকে বাঘে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা স্মরণে এলেও চোখে এখন আর অশ্রু গড়ায় না তার।
কমলার ভাসুর হরেন মন্ডল খাবার মুখে তুলতে তুলতেই বলেন, দু’ভাইকে হারিয়েছি। তবু তো বনে যেতিই হয়। কিন্তু ওয়ার্ল্ড টিম এয়েছে। তাই এখন আর বনে যাওয়া যাচ্ছে না। তারওপর চালের কেজি ৩৫ টাকা। তাও কার্ড পাচ্ছি না। সব কার্ড পাচ্ছে গেরস্থ।
ভাসুরের সঙ্গে কষ্ট ভাগ করতেই বুঝি ফের মুখ খোলেন কমলা। এবার বলেন, বহু কষ্ট কইরেছি। কুচা ধরে খেয়িছি। বর্ষা খেয়িছি। ঝড় খেয়িছি। টাকার অভাবে ছেলেটা পরীক্ষা দেতি পারলো না। আর কতো কষ্ট কপালে রয়িছে কে জানে!
জেলে পাড়ার মাথার ওপরে তখন মধ্যগণনের সূর্যটাকে ফের ঢেকে দিয়েছে পৌষের কুয়াশা। এভাবে বুঝি ঘণ কুয়াশায় প্রতিনিয়ত খাবি খায় কমলাদের জীবন। আসি আসি করেও সূর্যটা আসে না শেষ তক।
তাদের জীবন পাল্টাতে তাই কমিউনিটি বেসড ইকো ট্যুরিজম প্রয়োজন বলে মনে করেন পিযূষ পিন্টু। অনেক দিন ধরেই বাঘ বিধবা আর বাঘের কামড়ে আহতদের নিয়ে কাজ করেন তিনি।
তার বক্তব্য, বাঘ বিধবাদের জীবনের গল্প যে কোনো ট্যুরিস্টকে আকৃষ্ট করবে নি:সন্দেহে। আর দু’টা পয়সা পেলে জীবনটাও সহজ হবে বাঘ বিধবাদের।
আরো পড়ুন
** এ পাড়াতেও ঈশ্বর নেই!
** প্রাণ যায় যায় প্রাণসায়রে
** কুমির ফোটে করমজলে
** সুন্দরী বেয়ে বাঘ-কুমিরের কটকায়
** হিরণ পয়েন্টে হৃৎকম্পন
** ঘুম সাগরে জল অভিযান
** চাঁদের সাথেই মাছের প্রেম
** দুবলার সৈকতে মৃতদের মিছিল!
** সাগরের বুকে ভাসমান রাত
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
** দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
জেডএম