ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

কখনও দক্ষিণডিহির শ্বশুরালয়ে যাননি রবীন্দ্রনাথ!

আসিফ আজিজ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬
কখনও দক্ষিণডিহির শ্বশুরালয়ে যাননি রবীন্দ্রনাথ! দক্ষিণডিহি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি। ছবি: আসিফ আজিজ

বিষয়টি ভাবাচ্ছিল দক্ষিণডিহি যাওয়ার আগে থেকেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক’বার শ্বশুরালয়ে এসেছিলেন, তার কোনো স্মৃতি কি সেখানে সংরক্ষিত আছে?

খুলনা ঘুরে: বিষয়টি ভাবাচ্ছিল দক্ষিণডিহি যাওয়ার আগে থেকেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক’বার শ্বশুরালয়ে এসেছিলেন, তার কোনো স্মৃতি কি সেখানে সংরক্ষিত আছে? কিন্তু যতই জানার চেষ্টা করা হচ্ছিল, ততই তৈরি হচ্ছিল ধোঁয়াশা।

খুলনা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরের ফুলতলা থেকে আরও তিন কিলোমিটার ইজিবাইকে এগোলে দক্ষিণডিহির রবীন্দ্র কমপ্লেক্স। আগের ভাবনাগুলো আরও এলোমেলো করে দিলো সেখানে সংরক্ষিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দেখে। খুলনার পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত এ বাড়িতে গিয়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরও বেশি জানবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

খুলনার দক্ষিণডিহিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্বশুরবাড়ি সামনে থেকে।  ছবি: আসিফ আজিজকমপ্লেক্সের প্রবেশমুখে ও ভেতরে রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিনী মৃণালিনী দেবীর বাড়ি সম্পর্কে যে তথ্য আছে তার কোথাও রবীন্দ্রনাথ এ বাড়িতে এসেছিলেন কিনা তা নিয়ে বলা হয়নি, বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে আগ্রহ বাড়ে আরও। ইন্টারনেটে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতেও নতুন কিছু নেই। আর বাড়ির বিষয়ে বললে এখানে লাল ইটের বাড়িটির উপর বাহ্যিক কাঠামো ঠিক রেখে প্লাস্টার করে নতুন রঙের প্রলেপ ছাড়া কিছু চোখে পড়লো না। বাকি যেসব আলোকচিত্র আছে তা খুব সহজ্যলভ্য। অধিকাংশই রবীন্দ্রানুরাগীদের দেওয়া।

বাড়ির নিচতলার একটি ঘরে ছবির গ্যালারি।  ছবি: আসিফ আজিজরবীন্দ্রনাথের বিয়ের প্রসঙ্গের আগে একটু বাড়িটি নিয়ে বলে নেওয়া যাক। চার শতক জায়গার ওপর যে ভবনটি এখন দৃশ্যমান সেটি কবে কে নির্মাণ করেন তার সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। জানা যায়, বিয়ের আগে, অর্থাৎ ১৮৮৩ সালের আগে বেনীমাধব রায় চৌধুরীর যে বাড়িটি এখানে ছিল সেটি ছিল টিনের তৈরি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ে ভবতারিনী দেবী ওরফে ফেলীর বিয়ের পর নাকি বর্তমানে দৃশ্যমান দোতলা বাড়িটি তৈরি করা হয়। তবে কে তৈরি করেন তা স্পষ্ট করে কোথাও লেখা নেই। কেউ বলেন, বিয়ের পর নাকি রবীন্দ্রনাথ নিজেই এটি বানিয়ে দেন। তবে এর কোনো প্রামাণ্য তথ্য নেই।

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ির উপরের তলার একটি ঘরের গ্যালারি।  ছবি: আসিফ দোতলা বাড়িটিতে নিচে কক্ষ আছে ছোট-বড় চারটি। উপরে দু’টি। চারদিকে বারান্দা। একটি চিলেকোঠা। পেছনে রয়েছে একটি শৌচাগার। দীর্ঘদিন বাড়িটি ছিল অন্যের ভোগদখলে। ১৯৯৫ সালে উদ্ধার করা হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের স্বীকৃতি পায়। সংরক্ষণ করা হলেও বাড়িটির লাল ইটের কাঠামো ঠিক রাখা হয়নি। প্লাস্টার করে তার উপর বসানো হয়েছে রং। বেশি ভাঙা কিছু অংশ শুধু ফের ঢালাই বা গেঁথে সংস্কার করা হয়েছে।

খাঁজকাটা দরজা, লোহার গ্রিলের যে অংশটুকু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেগুলোতে অবিকল সংস্কার করা হয়েছে। ঘরজুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের শৈশব থেকে শুরু করে বার্ধক্য কাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র।
কমপ্লেক্সের মোট জায়গা তিন একর ১৪ শতক। সীমানা প্রাচীর ও গেটটি করা হয়েছে দক্ষিণ এশীয় পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের
অর্থায়নে। নিচতলায় একটি লাইব্রেরিও করা হয়েছে সম্প্রতি।

দক্ষিণডিহিতে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ির দোতলার বারান্দা।  ছবি: আসিফএবার আসা যাক বিয়ে প্রসঙ্গে। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে খুলনার পিরালি বংশের সখ্য ছিল বেশ। বিয়ের ক্ষেত্রে খুলনার দক্ষিণডিহির মেয়েদের পছন্দ ছিল ঠাকুর পরিবারের। পূর্বসূরিদের অনুসরণে ঠাকুরবাড়ির ছোটছেলে রবীন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী খুঁজতে খুঁজতেও তাই তার মামা বাড়ি দক্ষিণডিহি আসা। রবীন্দ্রনাথের মা সারদা সুন্দরী দেবী এই গ্রামের মেয়ে। বৌদি যশোরের মেয়ে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী) আরেক বৌদি কাদম্বরী দেবী, ভাইজি ইন্দিরা ও ভাইপো সুরেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর অছিলায় দক্ষিণডিহি আসেন। তবে ইন্দিরা দেবী ও রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, আসল উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী দেখা। জ্ঞানদানন্দিনী আবার ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে স্টাইলিশ নারী। পোশাক-আশাকে রীতিমতো বিপ্লব ঘটান তিনি। সেই স্মার্ট বৌদির কাঁধেই পড়ে রবির পাত্রী দেখার ভার।

রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ির পেছনের পাশে শৌচাগার।  ছবি: আসিফ আজিজদক্ষিণডিহি গিয়ে তারা সুন্দরী মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে দেবেন্দ্রনাথের সেরেস্তার কর্মচারী বেনীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে ফেলীকে পছন্দ হয় তাদের। ফেলীর বয়স তখন ১০/১১। আর রবীন্দ্রনাথের ২৩। ঠাকুরবাড়ির বধূদের আরও কম বয়সে বধূ করে আনা হতো তখন। যাইহোক পাত্রী রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কিনা সেটা নিয়েও গল্প প্রচলিত আছে। আবার রবীন্দ্রনাথের জীবনী ঘেঁটে জানা যায়, নিজের বিয়ের ভার তিনি বৌদিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি যে যশোরে এসেছিলেন সেটাও স্বীকার করতে চাননি। তবে এক চিঠিতে আবার স্বীকার করে ফেলেন, ওই সময় তিনি যশোর ছিলেন।

দক্ষিণডিহি শ্বশুরবাড়ির সামনে কাদম্বরী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি।  ছবি: আসিফপাত্রী পছন্দের পর কন্যাহ্বানে বিয়ে হয়। বিয়ের আগে পাত্রী যায় কলকাতা। বিয়ে হয় ছেলের বাড়িতে। বিয়ের পর ঠাকুরবাড়ির প্রথা অনুযায়ী ফেলীর নাম হয় মৃণালিনী দেবী। একই সঙ্গে বিয়ের পর মৃণালিনী একবার বাপের বাড়ি এসেছিলেন বলে জানা যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ বিয়ের পর একবারও এসেছিলেন কিনা তা কোথাও পাওয়া যায় না। এক মামলার সাক্ষ্য দিতে একবার যশোর এসেছিলেন বলে জানা গেলেও শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন কিনা তা জানা যায় না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণডিহি আসুন বা না আসুন এটি তার শ্বশুরবাড়ি এতে কোনো ভুল নেই। দেশ-বিদেশের মানুষ এই ভবনটি দেখার জন্য হলেও যান সেখানে। বাড়িতে অভ্যর্থনা জানানোর কেউ নেই এখন। তবে বাড়িতে ঢোকার মুখে সিঁড়ির দু’পাশে মৃণালিনী ও রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তির দিকে তাকালে মনে হয়, ঠাকুর বাড়ির একটি ঐতিহ্য ছিল। অভ্যর্থনা জানানোর কেউ নেই- বিষয়টি ঠিক না।

যেভাবে যাবেন: খুলনা থেকে বাসযোগে ২৫ টাকা ভাড়া দিয়ে ফুলতলা বাজার। বাজার থেকে জনপ্রতি ১৫ টাকায় ইজিবাইক অথবা ভ্যানে দক্ষিণডিহি। প্রবেশ ফি শিক্ষার্থীদের ৫ টাকা, সাধারণ মানুষের জন্য ১০ টাকা, বিদেশিদের ২০০ টাকা। খোলা থাকে মঙ্গল থেকে শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। সোমবার দুপুর ১টা ৩০ থেকে ৫টা। রোববার বন্ধ।

আরও পড়ুন:
**ইট-বালু গিলছে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতি
**খুলনায় বসে ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ দেখা!
**দাদার লাশ টোপ দিয়ে বাঘ শিকার করেন পচাব্দি গাজী
** ওষুধিগুণে চাহিদা বাড়ছে খুলনার চুইঝালের
** ষাটগম্বুজ মসজিদে কত গম্বুজ!
** চিনে খান খুলনার বিখ্যাত চুইঝাল
** ট্যাংরা-পারসের ছটফটানি বাগেরহাট বাজারে (ভিডিও)
** ‘উলুঘ খানের’ ঘোড়া দীঘি টানছে পর্যটক (ভিডিও)
** বাগেরহাটের মিনি কুয়েত!
** পরিযায়ী পাখি যাচ্ছে পর্যটক-ব্যবসায়ীর পেটে
** সুন্দরে এতো হিংসে কেন!

 

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬
এএ/এইচএ/

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ