বিলীন হওয়ার হুমকি মেখে যেনো মৃত্যুর দিন গুনছে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত কোনো বয়সী মানুষ।
কয়েকটা লিকলিকে নারিকেল গাছ তবু সাধ্যমতো পাতা পেতে ছায়া দিয়ে আগলে রাখতে চাইছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবনটাকে।
বাড়ির আড়ালে বলে ছোট্ট রাস্তাটার মোড় থেকে সহজে নজরে আসে না ঈশ্বরীপুরের এই হাম্মাম। কিন্তু ঠিকঠাক খুঁজে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী তো এখানেই ছিলো। ধুমঘাট থেকে এই ঈশ্বরীপুর পায়ে হাঁটা পথই তো। বংশীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকে মাত্র ১ কিলোমিটার এগুলেই শাহী মসজিদের পরই এই হাম্মাম।
ঈশ্বরীপুরের এই হাম্মাম মূলত রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজকীয় অতিথিশালার অংশ বিশেষ। স্থানীয়ভাবে হাবসিখানা বা জেলখানা নামেও পরিচিতি আছে এর। তবে নির্মাণ রীতি ও কৌশলে এটিকে হাম্মাম বা গোসলখানা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই। পূর্ব-পশ্চিমে এই হাম্মামের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৫০ ফুট। প্রস্থ ২১ থেকে ২৩ ফুটের মধ্যে। পূবের প্রশস্ততা পশ্চিমের চেয়ে একটু কমই হবে। এর পশ্চিমে দেওয়াল প্রায় সাড়ে ৩ ফুট পুরু। বাকিগুলো সোয়া দুই ফুট করে।
হাম্মামটিতে মোট কক্ষ ৩টি। পশ্চিমেরটি অপেক্ষাকৃত বড়। বর্গাকৃতি এ কক্ষের প্রতিটি বাহু সাড়ে ১৭ ফুট করে লম্বা। এ কক্ষেই হাম্মামে প্রবেশের পথ। উত্তর ও দক্ষিণে গড়া দুটো পথই খিলানযুক্ত। উচ্চতায় ৯ ফুট। এ কক্ষের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে ২টি করে ৪টি চতুর্কেন্দ্রিক খিলানযুক্ত কুলুঙ্গি। কক্ষটির ভেতরের অংশ ৪টি বর্গাকার পিলারে মোট ৯টি অংশে ভাগ হয়ে আছে। মেঝেতে বড় আকারের গর্ত হা মেলে আছে।
দ্বিতীয় কক্ষটিও বর্গাকার। পশ্চিমের কক্ষ থেকে এ কক্ষে প্রবেশের পথও পশ্চিমে। এখানে নির্মিত ৩টি খিলানযুক্ত জানালা পাশের কক্ষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাজ করছে। এ কক্ষের দেওয়ালে কুলুঙ্গির সংখ্যা ৮টি। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের কুলুঙ্গি বড় আকারের। প্রথম কক্ষের মতোই চার পিলারে এ কক্ষেরও ভাগ ৯টি। পুবের কক্ষটি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের। তবে অপর দু’টির মতো বর্গ নয়, এটি লম্বাটে আয়তাকার। এ কক্ষ আবার ৩ অংশে বিভক্ত। মাঝেরটি তুলনামূলক বড়। তবে তিনটির মেঝেতেই ৩টি গর্ত। মাঝেরটি বেশি গভীর। অনুচ্চ দেওয়াল তুলে তিন কক্ষকে পৃথক করা হয়েছে।
উত্তর ও দক্ষিণের বিস্তৃত দেওয়ালের গায়ে বেশ কিছু ছিদ্র আছে। এগুলো দিয়ে পানি সরবরাহ করা হতো বলে ধারণা করা হয়। কোনো কোনো ছিদ্রের দেওয়ালে পোড়ামাটির নলের চিহ্নও চোখে পড়ে।
ছাদের উপরে দু’টো গম্বুজ অবশিষ্ট। গম্বুজের শীর্ষভাগ ও আশপাশে চোঙ্গার মতো সরু ফুটোতে আলো প্রবেশের ব্যবস্থা। গম্বুজের নিচের দিকে কুইঞ্চের খিলানগুলো অভিক্ষিপ্ত হয়ে স্তম্ভের সঙ্গে মিশে গেছে। প্রতিটি স্তম্ভের এ অংশে ফুলের মোটিভ বসানো। এই ফুল কিছুটা মোচাকৃতির। মূল দালানের মধ্যে কয়েকটি কুঠুরি ও পানি সরবরাহের জন্য নল সদৃশ পাকা ছোট নালা পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত। পূর্ব দিকের ঘরের মধ্যভাগে পাথর দিয়ে পানি গরম করার ব্যবস্থা ছিলো। পাকা নলে ভেতরে সব কক্ষে সরবরাহ হতো সেই পানি। চৌবাচ্চার মুখে ঢাকনা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হতো পানির তোড়।
মুসলিম সংস্কৃতিতে এমন হাম্মামের ধারণা এসেছে রোমান সাম্রাজ্য থেকে। মধ্যযুগে বিভিন্ন স্থানে হাম্মামের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে আকার প্রকারে ভিন্নতার পরিচয় মেলে। মসজিদ আর সরাইখানার সঙ্গে সাধারণত এমন হাম্মাম গড়া হতো। যদিও নদী তীরবর্তী স্থানে হাম্মাম গড়া হতো বেশি।
পুরুষ ও নারীদের পৃথক হাম্মাম, কখনো একই হাম্মামে পুরুষ ও নারী পৃথক সময়ে ব্যবহার করতেন। গোসল ও শৌচকর্ম ছাড়াও ধর্মীয় আর সামাজিক কল্যাণের সঙ্গেও ছিলো হাম্মামের সম্পর্ক। খৎনা, বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক উপলক্ষ ধরে হাম্মামে যাওয়ার চল ছিলো।
হাম্মাম কখনো কখনো দরবার হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। বাদশাহ জাহাঙ্গীর তার হাম্মামের মধ্যে দরবার বসাতেন। কফি পান, বিশ্রাম, শৌচকর্ম, নামাজ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো বিভিন্ন অংশ। তবে এ হাম্মামে আলো ও আসন ব্যবস্থা না থাকায় এটিকে কেবল গোসলখানা হিসেবেই ব্যবহার করা হতো বলে ধারণা করা যায়।
হাম্মামের কাছে গড়া অতিথিশালার কোনো চিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট নেই। কখনো যে এমন কিছু এখানে ছিলো তা অনুমান করাও কষ্টকর। ১৯৮০/৮২ সালের দিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কিছুটা সংস্কার হাম্মামে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৬
জেডএম/এএ