এভাবে বলছিলেন, শেখ জাফর উল্লাহ। এক যুগের বেশি সময় তিনি পাউখালী প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদে ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন।
সাতক্ষীরার পাউখালী মোড় থেকে হাতের ডানে দক্ষিণ দিকে যে পথ চলে গেছে- গড়ের হাট পাওয়ার ৫ গজ আগেই বাম দিকে পড়বে লাল টেরাকোটায় নির্মিত মসজিদটি। কালীগঞ্জ থানা সদর থেকে প্রবাজপুর গ্রাম প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে।
যাওয়ার পথ সহজ না হলেও প্রতি জুমার ওয়াক্তে ভেতরে ৫ কাতার, বারান্দায় এক এবং বাইরে ছয় কাতার পূর্ণ হয়ে যায়। অন্যান্য দিন প্রতি ওয়াক্তে তিন কাতার মানুষ ইবাদতে দাঁড়ায়।
পুরনো নথিপত্র থেকে জানা যায়, আওরঙ্গজেবের সময় বা তার কিছু আগে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। হুকুমনামা দেওয়া হয়েছিলো ১৬৯৩ সালের ২৪ মে। খুলনা জজ কোর্টে এই মসজিদের সম্পত্তি সংক্রান্ত একটা মোকাদ্দমা হলে এর দলিলপত্র ও ফরমাননামা উদ্ধার করেন মসজিদ পক্ষের লোকজন। তা থেকে জানা যায়, নুরুল্লা খাঁ মসজিদের নামে ৫০ বিঘা জমি দান করেন এবং প্রবাজপুরের স্থানীয় সৈয়দ কাসিমকে মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় নুরুল্লা খাঁ যশোরের ফৌজদার পদে অধিষ্ঠিত হন। একই সঙ্গে তিনি যশোর, মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান এলাকার শাসক ছিলেন।
সৈয়দ কাসিমের পরে তার কয়েক পুরুষ সৈয়দ আওলিয়া, সৈয়দ আফসিয়া, সৈয়দ আবু নসর, সৈয়দ জামিরুদ্দীন, কাজী ফজলুল হক প্রমুখ মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করেন। নুরুল্লা খাঁ’র দান করা ৫০ বিঘা সম্পত্তি বর্তমানে মসজিদের দখলে নেই- রয়েছে এক একর তিন শতক।
শোনা যায়, বিক্রমাদিত্যের সেনাধ্যক্ষ পরবাজ (কেউ কেউ বলেন পারভেজ) খাঁ’র নামানুসারে প্রবাজপুর গ্রাম ও প্রবাজপুর শাহী মসজিদের নামকরণ করা হয়েছিলো। যদিও ইতিহাসে ‘পরবাজ খাঁ’ নামে কারও অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
উনিশ শতকের শেষ দিকে কালীগঞ্জের প্রবাজপুর ও এর আশে পাশের এলাকা বসতিহীন হয়ে পড়লে মসজিদটি মাটির নিচে চাপা পড়ে। ১৯৬৫ সালে হাজী সোহরাব আলীর নেতৃত্বে স্থানীয়রা যখন গাছপালা পরিষ্কার করেন, তখন দেখা যায়, এর মূল গম্বুজের কাছে বিশাল এক তেঁতুলগাছ গম্বুজের কিছু অংশে ফাটল ধরিয়েছে। মসজিদটি সংস্কার করে উত্তর-দক্ষিণে ফের টানা বারান্দা নির্মাণ করা হয়, তবে বারান্দার ছাদের গম্বুজগুলো আর নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয়দের আবেদনের ভিত্তিতে ১৯৮২ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর মসজিদ সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। ১৯৮৮ সালে কাজ শুরু করে একই রকম করে তিনটি গম্বুজ নির্মাণ করে। এক গম্বুজের মসজিদটির দু’টি অংশ রয়েছে। গম্বুজকক্ষ ও বারান্দা। পশ্চিম দেয়ালে দু’পাশে দু’টি এবং মাঝখানে একটি মিহরাব আছে। মোট ৫টি দরজা। মেঝে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় সাত বছর টাইলস করা হয়। উত্তর দিকে পুকুরের পাশে নতুন করে নির্মাণ করা হয় ঈদগাহ মাঠ ও ওজুখানা। মুষ্ঠির চাল, মাসিক চাঁদা এবং দানের টাকায় চলে মসজিদ ব্যবস্থাপনা এবং আনুষাঙ্গিক খরচ।
লোহার গ্রিলের ছোট দরজা পেরিয়ে মসজিদ সীমানায় ঢুকলে দেখা যাবে শ্যাওলায় কালচে হয়ে গেছে লাল ইট। দেয়াল থেকে মাঝে মাঝে খসে পড়ছে গুঁড়ো। ভেতরের অবস্থাও বেশ নাজুক। মসজিদের ভেতরে রয়েছে একটি পাথর, এখানে এসে কারও মনের আশা পূর্ণ হলে দুধ দিয়ে সেটি ধুয়ে দিয়ে যান। এভাবেই বিশ্বাসে বুকে জায়গা করে রেখেছে অপরূপশৈলীর লাল ইটের টেরাকোটার মসজিদ।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৬
এইচএ/
**সেকেন্দার ডাক্তারের বাড়িই একখণ্ড সুন্দরবন