ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

তিন লক্ষবার হরিনাম জপ না করে খেতেন না হরিদাস

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৭
তিন লক্ষবার হরিনাম জপ না করে খেতেন না হরিদাস যশোরের বেনাপোলে ‘নামাচার্য ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুর পাটবাড়ি আশ্রম’/ছবি: আসিফ আজিজ

এ ইতিহাসের শুরু আরও অনেক আগে। ঠিক এখানে, মানে- যশোরের বেনাপোলে‌ বা সাতক্ষীরার কলারোয়ায়ও নয়। সাতক্ষীরায় তার জন্ম হলেও এটি তার প্রথম জীবন নয়, জন্মান্তর মাত্র। কারণ তিনি ব্রহ্মা, তাই গল্পের শুরু সেই ব্রহ্মলোকেই। মর্ত্যে তার এটি দ্বিতীয় জন্ম। স্বেচ্ছায় নয়, বরং স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাতেই তার মর্ত্যলোকে আবির্ভাব। স্বর্গ থেকে কেন এই মর্ত্যে আগমন- সে গল্প আরও দীর্ঘ। সংক্ষেপে শুধু বলে রাখা-ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শাস্তিরূপেই  তাকে এ মর্ত্যলোকে পাঠান।

আশ্রমের একটি জায়গায় বসে তিনি তিনলক্ষ বার হরিনাম জপ করতেন। সে কারণেই মর্ত্যলোকে তিনি হরিদাস নাম ধারণ করলেন।

ভক্তরা বলেন- ঠাকুর হরিদাস।

বর্তমানে যেখানে ‘নামাচার্য ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুর পাটবাড়ি আশ্রম’ প্রতিষ্ঠিত সেখানেই ঠাকুর হরিদাস একটি কুটিরে বসে হরিনাম জপ করতেন। যশোরের বেনাপোলেই রয়েছে এই আশ্রম। হরিদাসের নামেই বেনাপোল সীমান্ত চেকপোস্টের নামকরণ হয় হরিদাসপুর।

মর্ত্যলোকে হরিদাসের জন্মান্তর ঘটে সাতক্ষীরার কলারোয়া থানার কেড়াগাছি গ্রামে আজ থেকে সাড়ে পাঁচশ’ বছরেরও আগে। কিন্তু যে হরিনামের জন্য তার এ মর্ত্যে আসা, সেই হরিনামই হয়ে গেলো তার কাল। জন্মভিটা থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিলেন বেনাপোলের এই জায়গাটিতে। সেখানে এখন বড় আশ্রম হয়েছে, কিন্তু সেদিন শুধু হরিদাস একটি পর্ণকুটিরে বসেই হরিনাম জপ করতেন।
আশ্রমের ভেতরে দেব-দেবীর মূর্তিঠাকুর হরিদাস মাধুকরী পদ্ধতিতে অর্থাৎ, ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। যেদিন তিনি তিনলক্ষ বার হরিনাম ভজন করতে না পারতেন সেদিন কোনো খাবার খেতেন না।

হরিদাস কীর্তন করতেন। সে কীর্তনে মুগ্ধ হয়ে যেতো সবাই। ধীরে ধীরে তার নাম-যশ ছড়িয়ে পড়লো। ফলে হরিদাসের পর্ণকুটিরে মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেলো। তৎকালীন স্থানীয় জমিদার রামচন্দ্র বিষয়টিকে ভালোভাবে নিলেন না। জমিদার হরিদাসের পর্ণকুটির আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য লোক পাঠালেন। কিন্তু তারা বিফল হয়ে ফিরে গেলো। বেঁচে গেলো হরিদাসের পর্ণকুটির।

কিন্তু জমিদারও দমবার পাত্র নন। তিনি নতুন এক চাল চাললেন। হরিদাসের নাম ভজন লণ্ডভণ্ড করতে ও তার ধ্যান ভাঙাতে এক বাঈজীকে নিয়োগ করলেন। কিন্তু হরিদাসের নাম ভজনে বাঈজীর ছলাকলাও বিফলে গেলো।
আশ্রমের ভেতরের একাংশহরিদাসের বিরুদ্ধে কেবল জমিদার রামচন্দ্রই লোক-লস্কর-বাঈজী পাঠিয়ে তাকে শায়েস্তা করতে চাননি। এই চেষ্টায় আরও যুক্ত হয়েছিলেন গড়াই কাজী ও হুসেন শাহ। হরিদাসকে শাস্তি দেওয়ার জন্য গড়াই কাজী সুলতানকে চাপ দিতে থাকেন। তাকে চাবুকের আঘাতের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাইশ বাজার নামক স্থানে তাকে চাবুক মারা হয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-তিনি যে অর্ন্তযামী। প্রিয় শিষ্যকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, চাবুক মারা হচ্ছে, ভগবান তা ঠিকই জানতে পারলেন। তাই তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। । তিনি শিষ্যদের হরিদাসকে বাঁচানোর আদেশ দিলেন। হরিদাস তার মহাপ্রভুর কাছে বললেন, হে মহাপ্রভু, ওরা কিছু জানে না, ওরা অবুঝ, তাই আমাকে শাস্তি দিচ্ছে, তুমি ওদের ক্ষমা করে দাও!

কিন্তু তার শিষ্য কি চাবুকের মার খেয়েই যাবে? না, তা হয় না। তাই মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ নিজেই তার দেহ হরিদাসের দেহের ওপর আস্তরণ করে দিলেন। হরিদাসের সমস্ত চাবুকাঘাত তিনি নিজদেহে ধারণ করলেন। এভাবেই তিনি তার প্রিয় শিষ্য হরিদাসকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালেন। ভগবান আর শিষ্য এক হয়ে গেলেন।
আশ্রমের ভেতরে একাংশমহাপ্রভু হরিদাসকে আলিঙ্গন করতে গেলেন। সে দৃশ্য দেখে অভিভূত হলেন অদ্বৈত প্রভু আর নিত্যানন্দ প্রভু। এ যে গুরু-শিষ্যের এক মহামিলন! ব্রহ্মা আর দেবতার এক মহামিলন।

কিন্তু হরিদাসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বন্ধ হলো না। সব ধরনের কীর্তন বন্ধ করা হলো। একদিন সকালে তার কীর্তনের সব আয়োজন ভেঙে দেওয়া হলো।

কিন্ত মহাপ্রভু তা মেনে নেবেন কেন? সন্ধ্যায় প্রভুকৃষ্ণ তার শিষ্যদের আদেশ দিলেন, নগরদ্বীপকে আলোর মালায় সাজিয়ে দাও। তাই হলো। সন্ধ্যায় সবাই মিলে হরিনাম সংকীর্তন আর পথকীর্তন করতে শুরু করলেন। এ এক মহানাম ভজন। হরিদাসের সঙ্গে এ কীর্তনে শামিল হলেন অদ্বৈত প্রভু, নিত্যানন্দ প্রভু, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। স্বর্গ আর মর্তলোকে গীত হলো হরিনাম। সে নাম ভজনে শামিল হলেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর দেবতারা।

এভাবে হরিনাম ভজন করতে করতেই হরিদাস তার জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন। এক পর্যায়ে বয়সের কারণে তিনি তিনলক্ষ বার নাম ভজন করতে পারতেন না। তিন লক্ষবার নাম ভজন না করতে পারায় তিনি ভোগ গ্রহণও বন্ধ করে দিলেন। মহাপ্রভু শিষ্যের এই অবস্থা দেখে বিচলিত হলেন।
আশ্রমে ঠাকুর হরিদাসের  ভক্ততিনি সেবক গোবিন্দকে হরিদাসের জন্য স্বর্গীয় ভোগ নিয়ে পাঠালেন। হরিদাস গোবিন্দকে বললেন, ‘আজ আমি কোনো ভোগ গ্রহণ করবো না। কারণ আমি তিনলক্ষ বার নাম ভজন করতে পারিনি’। কিন্তু তিনিতো আবার মহাপ্রভুর মহাপ্রসাদও ফিরিয়ে দিতে পারেন না। তাই তিনি মহাপ্রসাদ থেকে একটি অন্নকণা গ্রহণ করলেন।

গোবিন্দ মহাপ্রভুকে হরিদাসের একথা জানালেন। মহাপ্রভু সন্ধ্যায় হরিদাসের কাছে এসে বললেন, তোমার এতো ভজনের কী দরকার? কিন্তু হরিদাস পণ করলেন, যে মুখ তিন লক্ষবার প্রভুর নাম জপ করতে পারে না তার বেঁচে থাকা উচিৎ নয়। ফলে মহাপ্রভুর দুই পদযুগল বুকে ধারণ করে তিনি মৃত্যুকে বরণ করলেন।

হরিদাসের মৃত্যুর পর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার মরদেহ নিজের হাতে করে নৃত্য করতে করেত এগিয়ে গেলেন। কারণ, মহাপ্রভু জানতেন, হরিদাস আসলে ভ্রহ্মা। তাই নিজের কোলে মাথা রেখেই হরিদাসকে স্নান করাচ্ছেন। ভক্তরা বলতে লাগলো, ‘আজ এ মহাসমুদ্র এক মহাতীর্থে পরিণত হলো’। মহাপ্রভু হরিদাসের সমাধিস্থলে একটি মন্দির করে দিলেন। যা আজও বিদ্যমান। সেখানে তার ভক্তবৃন্দ আজও হরিনাম সংকীর্তন করছেন।
আশ্রমে ঠাকুর হরিদাসের  ভক্ত

হরিদাসের মর্ত্যলোকের এই জীবন কথা পুরোটাই মূর্ত হয়ে আছে পাটবাড়ি আশ্রমে। একটি জাদুঘরে মূর্তিরূপে তার জীবন-কাহিনীকে তুলে ধরা হয়েছে। আশ্রমের সেবাইতের কাছেই জানতে পারলাম হরিদাসের সেই হরিনাম যজ্ঞের ইতিবৃত্ত। এ আশ্রম তার জীবনের আরও অনেক ঘটনারই সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ