ঢাকা, সোমবার, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩ শাবান ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বেওয়ারিশ কুকুর আতঙ্কে নগরবাসী

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২০
বেওয়ারিশ কুকুর আতঙ্কে নগরবাসী

চট্টগ্রাম: ফাঁকা রাস্তায় বেড়েছে বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাত। দিনে বিচরণ কম চোখে পড়লেও বিকেল গড়াতেই বাড়ছে সংখ্যা। নগরের বিভিন্ন অলিগলি ও সড়কে কুকুরের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে রাতের নিস্তদ্ধতা ভাঙছে। ক্ষুধার্ত কুকুর হামলে পড়ছে পথচারীর ওপরও।

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর মুহূর্তে নগরে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এতে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারের সামাজিক আয়োজন।

হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় সেখানেও নেই রান্নার ব্যবস্থা। তাই রান্না করা খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলা হচ্ছে না ডাস্টবিনে।
এর ফলে খাবারের সংকটে পড়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কুকুরগুলো।  

এ অবস্থায় নগরের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়ানো অভুক্ত কুকুরদের জন্য রান্না করা খাবার দিচ্ছেন চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। কুকুর-বিড়ালের অবস্থা উপলব্ধি করে এলাকাভিত্তিক প্রতিদিন একবেলা খাবার তুলে দিচ্ছেন পশুপ্রেমী আমির ইসাবা ফারুক নামে এক ছাত্র। ফেসবুকভিত্তিক ‘অ্যানিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রাম’ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোক্তা উষা আচার্য্য, তিশা ভট্টাচার্য, ইয়ানা হক ও সুমী বিশ্বাস পথের কুকুরের জন্য রান্না করা খাবার দিচ্ছেন। রেড ক্রিসেন্ট-চট্টগ্রামের স্বেচ্ছাসেবীরাও কুকুরকে খাবার দিয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তির চেষ্টা চালাচ্ছেন।

তবে এর পরও বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাত থামেনি। বছরের এই সময়টাতে জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি হাতে নেওয়া হলেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তা সংক্ষিপ্ত করা হয়।  

জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জানান, মার্চ মাসে ১৭-২১ মার্চ ৫ দিনে নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের উদ্যোগে জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির আওতায় ১০ হাজার ৯১৮টি কুকুরকে জলাতঙ্ক টিকা দেওয়া হয়েছে। কর্মসূচিতে ৪৫টি টিমের ৯০ জন সদস্য, ৪৫ জন সার্ভেয়ার, ৪৫ জন টিকা প্রদানকারী ও স্থানীয় ৪৫ জন অংশ নেন। চট্টগ্রাম প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকারের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।  

চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিকে কর্মরত সংবাদকর্মী সাইফুল ইসলাম সম্প্রতি সন্ধ্যায় অফিসে যাওয়ার সময় কুকুরের হামলার শিকার হন। পরনে জিন্স প্যান্ট থাকায় কোমরে কামড় বসানোর চেষ্টা করলেও সে যাত্রায় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন বলে জানান তিনি।  

নন্দনকানন এলাকায় মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) রাতে ফুটপাতে থাকা কয়েকজন ভাসমান মানুষ ত্রাণের খাবার খিচুড়ি খাওয়ার সময় কয়েকটি ক্ষুধার্ত কুকুর তাদের ওপর হামলে পড়ে। সম্মিলিত প্রতিরোধে তারা রক্ষা পেলেও গায়ে আঁচড় লেগেছে বলে জানিয়েছেন।  

একই ধরনের ঘটনার কথা জানান বহদ্দারহাট, চকবাজার, পাথরঘাটা, আলকরণ, টেরিবাজার, আগ্রাবাদ, মুরাদপুর, পতেঙ্গা, খুলশী, পাহাড়তলী এলাকার কয়েকজন ভুক্তভোগী।

চিকিৎসকরা বলছেন, কুকুরের কামড়ে সংক্রমণ, টিটেনাস রোগের আশঙ্কা থাকে। শিশুদের নাক-মুখে কুকুর কামড়ালে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই তারা মারা যায়। র‌্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানর বা চিকার মাধ্যমে জলাতঙ্ক রোগ ছড়ায়। আমাদের দেশে মূলত কুকুরের কামড়ে বা আঁচড়ে (রক্ত বের না হলেও) জলাতঙ্ক রোগ বেশি হয়।

তাদের মতে, শরীরের কোন অংশে কামড় বা আঁচড় দিয়েছে, তার মাত্রার ওপর নির্ভর করে কতদিনে জলাতঙ্ক দেখা দেবে। সাধারণত এক সপ্তাহ থেকে তিন মাসের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। শরীরের নিচের অংশে কামড় বা আঁচড় দিলে এবং এর মাত্রা কম হলে সাত বছর সময়ের মধ্যে যেকোনো সময় জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে মানুষ সাধারণত বাঁচে না।  

‘আক্রান্ত ব্যক্তি অস্বাভাবিক আচরণ করে। ক্ষত স্থানে ব্যথা হয়, জ্বালাপোড়া করে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ঢোক গিলতে গলায় ব্যথা লাগে। জ্বরও হতে পারে। খিঁচুনিও হতে পারে। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ইচ্ছা থাকলেও পানি খেতে পারে না। বাতাস সহ্য করতে পারে না। মৃত্যুর আগে আলো দেখলে ভয় পায়। আবার পা থেকে শুরু করে পুরো শরীর অবশ হয়ে যেতে পারে’।  

জলাতঙ্কের প্রধান বাহক পথকুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাতঙ্ক রোগের টিকা দিতে গত বছরের জুন মাসে একটি প্রকল্পের অধীনে কাজ শুরু করে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)। কুকুরকে হত্যা না করে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ এবং রোগমুক্ত করাই ছিল এ প্রকল্পের লক্ষ্য। অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হলেই এসব কুকুরকে ছেড়ে দেওয়া হতো।  

বিশ্ববিদ্যালয়টির ফিজিওলজি ও প্রাণিকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ রাশেদুল আলমের নেতৃত্বে সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তুলি দেসহ শল্যচিকিৎসকরা ‘নিউটার (বন্ধ্যাকরণ)’, ‘ভ্যাকসিন (জলাতঙ্ক টিকা)’ প্রদানের কাজও করেছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেশ কিছু কুকুরের বন্ধ্যাকরণ সম্পন্ন হয়।  

আক্রান্ত কুকুর চেনার উপায় 

র‌্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুর যেখানে যা পায়, কামড়ানোর চেষ্টা করে। উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটে বেড়ায়। মুখ থেকে লালা পড়তে থাকে। সারাক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে। একপর্যায়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। খাবার দিলেও খেতে পারে না।  

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির আওতায় ইতোমধ্যে কুকুরকে জলাতঙ্ক টিকা প্রদান করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন জনস্বাস্থ্য নিয়েই ভাবতে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের পর ক্ষতস্থান ক্ষারযুক্ত সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে অন্তত ১৫ মিনিট ধরে ধুয়ে নিতে হবে এবং র‌্যাবিস ভাইরাসের টিকা নিতে হবে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায়। কুকুরের কামড়ে জখমের ধরণ অনুযায়ী এন্টি র‌্যাভিস ভ্যাকসিন (এআরভি) ও ইআরআইজি নামের দুটি ভ্যাকসিন শরীরে দিতে হয়। বাড়িতে পোষা প্রাণিকে নিয়মিত টিকা দেয় সিভাসু। বেওয়ারিশ কুকুর থেকে সাবধান থাকার পরামর্শও দেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২০
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।