জাহাজ ভাঙা শিল্পের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইতোপূর্বে জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আগাম কর দিতে হতো না। কেবল প্রতি টনে ৩০০ টাকা হারে কর পরিশোধ করতে হতো।
এ আগাম কর পরবর্তীতে সমন্বয় ও ফেরত প্রদানের নিয়ম থাকলেও তা ফেরত পাচ্ছেন না শিল্প মালিকরা।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরে এখনও পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে ২৩৮ কোটি টাকা ফেরত পাবার কথা। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন এবং তার বিপরীতে মোটা অংকের সুদ দিতে হয়। তাছাড়া সার্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেখানে তারল্যের ব্যাপক সংকট সেখানে আগাম কর আদায় করার ফলে একদিকে যেমন সুদ বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা মূলধন সংকটে পড়ছেন। এর প্রভাব পড়েছে এ খাতে।
দেখা যায়, নতুন রাজস্ব নীতিতে ৫ শতাংশ আগাম কর ধার্য করায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাহাজ আমদানির পরিমাণ ও সরকারকে রাজস্ব প্রদানের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ছিল।
২০১৫-২০১৬ সালে আমদানি করা ২৫০টি জাহাজ থেকে (এলডিটি-৩১.০৫) রাজস্ব প্রদান করা হয় ৮২২ কোটি টাকা, ২০১৬-২০১৭ সালে ১৮৮টি জাহাজ থেকে (এলডিটি-২৩.৮৬) রাজস্ব প্রদান ৬৩২ কোটি টাকা, ২০১৭-২০১৮ সালে ২০২টি জাহাজ থেকে (এলডিটি-২২.৪৯) রাজস্ব প্রদান ৫৯৬ কোটি টাকা, ২০১৮-২০১৯ সালে ২৭২টি জাহাজ থেকে (এলডিটি-২৯.৯১) রাজস্ব প্রদান ৭৯২ কোটি এবং ২০১৯-২০২০ সালে ১৩৮টি জাহাজ থেকে (এলডিটি-১৫.৬৮) রাজস্ব প্রদান করা হয় ৪৭৮ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে ২৭২টি জাহাজ আমদানি করা হয় এবং সরকারকে মোট ৭৯২ কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করা হয়, সেখানে চলতি অর্থবছরে জাহাজ আমদানি কমে ১৩৮টিতে দাঁড়িয়েছে। যার রাজস্ব ৪৭৮ কোটি টাকা আগাম কর ও ভ্যাট হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়েছে। নতুন নীতির কারণে সরকারের কোষাগারে অর্থ জমছে কম। বিপরীতে আমদানিকারকরাও পুঁজিশূন্য হয়ে পড়ছেন। জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ায় বেকার শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, সরকারের নতুন রাজস্ব নীতির কারণে এ শিল্পের উদ্যোক্তা এবং রাষ্ট্র উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন নীতিতে করদাতারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেড়ে যাওয়ায় এ খাত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে, করোনা ভাইরাসজনিত অথনৈতিক মন্দা মোকাবিলা ও এই খাতকে টিকিয়ে রাখার জন্য আসন্ন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তথা সরকারের নীতি সহায়তা কামনা করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
বিএসবিআরএ’র নির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, সরকারের নতুন নীতির কারণে গত একবছরে জাহাজ আমদানি অর্ধেক কমে গেছে। সে হারে রাজস্বও কমেছে অর্ধেক। আমরা চাই শিল্প মন্ত্রণালয় যে অনুরোধ করেছে, এনবিআর যেন তা বাস্তবায়ন করে। তাহলে এই শিল্পটাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
তাদের এ দাবিকে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ও এ খাত হতে আগাম কর প্রত্যাহার ও ভ্যাটের পরিমাণ পুনঃনির্ধারণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সম্প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। ব্যবসায়ীরা এর সফল বাস্তবায়ন দেখতে চান এবং একটি হয়রানিমুক্ত যৌক্তিক ব্যবসার পরিবেশ ফিরে পেতে চান।
প্রসংগত, প্রতি বছর সারা বিশ্বে পুরনো জাহাজ আমদানি করে উপকূলীয় এলাকায় কেটে বিক্রি করা হয় আনুমানিক এক কোটি মেট্রিক টন। এরমধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে আমদানি হয় ৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন পুরনো জাহাজ আমদানি করে যা মোট পুরনো জাহাজের আমদানির ২৫ শতাংশের বেশি। এই শিল্পের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে সরকারের কোষাগারে শুল্ক ও অন্য খাতে রাজস্ব হিসেবে জমা হয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০২০
এসি/টিসি