কুটির শিল্পের কাজ করার ফাঁকে কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর রেলওয়ে স্টেশনের এলাকার বাসিন্দা নাগিনা রানী বেদ।
স্বামী, ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে ছোট একটি সংসার নাগিনা রানীর।
বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত সূর্যের আলো দেখা যায়নি। একটু পরেই আলো ফুটতেই দেখা গেল এক নারী হাতে একটা চাকু, কিছু বাঁশের চটা রেল লাইনের পাশের বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। রেল লাইনের ধারে সেগুলো রেখে আবারো বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। খানিক্ষণ বাদে একটা অ্যালুমিনিয়ামের কলসী আর মাদুর নিয়ে আবারো এলেন রেল লাইনের ধারে। একটা মাদুর পেতে বসলেন তিনি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো দ্রুত তৈরি করছেন বাঁশের চাটাই দিয়ে বাহারি জিনিসপত্র। কৌতূহলবসত কাছে গিয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। এরপর কথা হলো তার সঙ্গে।
নাগিনা রানী বেদ বাংলানিজকে বলেন, আমরা তো গরীব মানুষ। তার উপরে বেদ। সমাজে আমাদের অবস্থান নিচু। সকলের সঙ্গে মিশতেও পারি না। প্রায় সব ক্ষেত্রেই একটা অবহেলা। বাঁশের ঝুড়ি, কুলা তৈরি করে সংসার চালাই।
তিনি বলেন, বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করে সংসার চালাই। আমি বাঁশের তৈরি ডালা, শরপশ (ঢাকনা), ফুলদানী, কুলা, কলমদানী, ঝুঁড়ি, ঝাঁকাসহ বিভিন্ন সাংসারিক ব্যবহারের জিনিসপত্র তৈরি করি। আমি তৈরি করি আর স্বামী তা বাজারে বিক্রি করে। নিজে লেখাপড়া করার মতো সুযোগ পাইনি। সংসারটা কষ্ট করে চালায় এর মধ্যে ছেলেকে মেকানিক ইঞ্জিনিয়ার করেছি। এখন বিএসসি পড়াচ্ছি। সেই সঙ্গে মেয়েকেও হাই স্কুলে ভর্তি করেছি।
নাগিনা রানি বেদের স্বামী সুকুমার বেদ বাংলানিউজকে বলেন, একা কাজ করে সংসার চালানো খুবই কষ্ট। আমরা অন্য কাজ ভালো পারি না। আমি বাঁশ কিনে এনে দেই আর নাগিনা সেটা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে। প্রতি মঙ্গলবার মিরপুর হাটে সেটা বিক্রি করি।
তিনি বলেন, বাঁশের তৈরি বিভিন্ন ঝুঁড়ি, কুলা, ফুলদানী, ডালা গড়ে ২৫ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা পর্যন্ত হয়। হাটের চেয়ে গ্রামে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতে গেলে একটু বেশি লাভ হয়। এগুলো তৈরিতে তবলা বাঁশ ব্যবহার করা হয়। তবে বাঁশ আর আগের মতো পাওয়া যায় না। আমাদের মতো প্রায় ৩০ জন এ কাজ করে। আমাদের মধ্যে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। কেউ রাজ মিস্ত্রির কাজের জোগালে দেয়, কেউ সেলুনে কাজ করে, কেউ ভ্যান চালায়। ”
কবিতা রানী বেদ বাংলানিউজকে বলেন, এ কাজ করে সংসার চালানো খুবই কষ্ট হয়ে যায়। সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা এখনো পাইনি। আর আমাদের ট্রেনিং দেবে কারা? আমরা তো আর সরকারি লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি না। তাই আমাদের প্রশিক্ষণ দেয় না কেউ।
নাগিনা রানীর বেদের মতো এমন ২৫-৩০ ঘর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এ কুটির শিল্পের কাজ করে সংসার চালায়।
প্রদীব বেদ বাংলানিউজকে বলেন, আগের মতো আর ইনকাম হয় না। এক চালান বাঁশের কাজ করলে ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা হয়। সেটা করতে সময় লাগে ৮/১০ দিন। তবে পেটে ক্ষুদা থাকলে সেটা দ্রুতই হয়। আমাদের নারীরা এ কাজে আরো প্রশিক্ষণ পেলে ভালো করতে পারবে।
এসব ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কাজ করে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আলো নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
আলো সংস্থার নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমার এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির জীবন মান উন্নয়নের চেষ্টা করছি। তাদের শিক্ষিত করতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। এদের মধ্যে একটা জড়তা কাজ করে। সরকারি সাহায্য সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণে এরা খুব একটা অগ্রসর না।
মিরপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ক্রেডিট সুপারভাইজার সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা মূলত নারীদের বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজের উপরে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এর মধ্যে নারীদের সেলাই ও নঁকশী কাঁথার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। যদি সেলাই ও নঁকশী কাঁথার প্রশিক্ষণ নিতে কোন নারী আগ্রহী হয় তাহলে আমরা তাকে প্রশিক্ষণ দিতে পারি। তবে বাঁশের কাজের উপরে প্রশিক্ষণ প্রদানের কোর্সের ব্যবস্থা নেই।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম নান্নু বাংলানিউজকে বলেন, আমরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। কুঁটির শিল্পে উপরে বা হস্ত শিল্পের উপরে কেউ প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগ্রহী হলে আমরা তাকে প্রশিক্ষণ দিতে পারি। তবে বেদ সম্প্রদায়ের লোকজন কুঁটির শিল্পের কাজ করলেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করার কাররণ প্রশিক্ষণ পায়নি তারা। তারা আবেদন করলে আমরা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০২০
এসএইচ