কয়রায় বাম্পার ফলনে ভরে উঠেছে মুগডালের ক্ষেত, যা ভুলিয়ে দিয়েছে কৃষকের ঘামঝরা শ্রমের কষ্ট। ছোট ছোট মুগডাল গাছের প্রতিটি ডগাতে যেন ফুটেছে কৃষকের হাসি।
সময় মতো বীজ, সার, ওষুধের সহায়তা, পরিচর্যা ও সরেজমিনে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেবা ও পরামর্শ পাওয়ায় ফলন ভালো হয়েছে বলে মনে করছেন চাষিরা। খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত কৃষিজমিতে মুগডালের বাম্পার ফলন দেখে এ এলাকার কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে।
চলতি বছরের শুরুতেই সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার আমাদী, মহারাজপুর, কয়রা ও বেদকাশি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে প্রাথমিকভাবে মুগডালের চাষ করেন কয়েকজন কৃষক। ডাল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সরেজমিন গবেষণা বিভাগ কয়রা উপজেলা এমএলটি সাইট।
জানা গেছে, যেসব কৃষিজমি আমন ধান কাটার পর বর্ষা মৌসুম পর্যন্ত গো-চারণভূমি হিসেবে ব্যবহত হতো, সেসব জমিতে এখন মুগডালের গাছে সবুজের সমারোহ। কৃষক সুভাস মন্ডল বলেন, ‘আমি চণ্ডিপুর গ্রামে তিন একর জমিতে মুগডালের আবাদ করেছি। এখন ফসল তোলার সময়। এ এলাকায় সব মাঠে শুধু আমন চাষ হয় এবং বাকি সময় গরু-ছাগল চরে। চলতি বছরের শুরুতেই কয়রা কৃষি গবেষণা বিভাগের জাহিদ হাসান আমাদের এলাকায় এসে মুগডাল, ভুট্টা, সূর্যমুখী, তরমুজ চাষ করতে বলেন এবং আমাদের সার ও বীজ দিয়ে সহযোগিতা করবেন বলে জানান। কিন্তু এলাকার অনেকেই তার কথায় অবিশ্বাস করে বলেন, লবণমাটিতে ঐসব ফসল লাগালে পরিশ্রমই বৃথা যাবে। তবে আমি এবং আমার প্রতিবেশি মিলন ও রাজ প্রাথমিকভাবে ১০ বিঘা জমিতে মুগডালের চাষ করি। বর্তমানে এ পতিত জমিতে মুগডালের ফলন দেখে এলাকার অনেকেই আগামীতে ডাল চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ’
তিনি বলেন, ‘এ পতিত জমিতে এমন ফসল হবে তা আমি ভাবতে পারিনি। ’
জানা গেছে, কৃষি গবেষণা বিভাগের এমএলটি সাইট কয়রায় দায়িত্বপ্রাপ্ত জাহিদ হাসান বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের এক ফসলের জমিতে দুই ফসল আবাদের জন্য এবং শুষ্ক মৌসুমে অন্য ফসল চাষে আগ্রহী করে তোলেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আগ্রহী কৃষকদের একটি তালিকা দিলে সরেজমিন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউশন খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হারুনর রশীদ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল কয়রার বিভিন্ন কৃষকের মাঠ পরিদর্শন করেন।
এসময় কৃষকদের আশ্বস্ত করে তারা বলেন, আমরা বেড প্লান্টার যন্ত্র দিয়ে মুগডাল বপনসহ সার, বীজ ও কীটনাশকের ব্যবস্থা করে দেবো। এছাড়া উৎপাদিত ফসল সবই আপনাদের থাকবে এবং আপনারা এ ফসলের ক্ষেত দেখাশুনা করবেন।
মুগডালসহ অন্য ফসল চাষ শেষে সম্প্রতি এসব কৃষকের মাঠ পরিদর্শনে আসেন ড. হারুনর রশীদের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার কৃষিবিজ্ঞানী ড. এলিক হার্টনার, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের ইনচার্জ ড. আক্কাস আলী ও এমজি নিয়োগিসহ অনেকেই।
এ বিষয়ে ড. হারুনর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমিতে লবণাক্ততার মাত্রা দিনদিন বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে তাপমাত্রা, খরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত। এ কারণে উপকূলের কৃষকরা শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ করে কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারছেন না। ফলে উপকূলের বেশীরভাগ কৃষক এ সময়ে চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সারা বছর শুধু বৃষ্টির মৌসুমে একটি ফসল আমন ধান করেই কৃষকদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বাকি সময় অর্থাৎ পুরো শুকনো মৌসুমে হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকছে। আমি কৃষিবিদ হয়ে স্বপ্ন দেখতাম দেশের অন্য এলাকার মতো আমার জন্মভূমি কয়রার মাটিতে দু’টি ফসল হবে। সে কারণে আমি আইলা পরবর্তী মহারাজপুর বিলের বোরো ধানের আবাদ চাষে সফল হয়েছি এবং দ্বিতীয়বার একই লবণাক্ত মাটিতে সূর্যমখী, মুগ, তরমুজ, চীনাবাদাম , ভুট্টার আবাদ সফল হওয়াই কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের উপকূলীয় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ৩০ শতাংশ জমি লবণাক্ত। এখানে পানিও লবণাক্ত থাকায় মাঠে দু’টি ফসল ফলানো কঠিন। অথচ আমার দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সেখানে একাধিক ফসল চাষ সম্ভব হয়েছে। এবার প্রথমবারের মতো কয়রা ইউনিয়ন, আমাদী, মহারাজপুর, উত্তর বেদবাশি ইউনিয়নের ৫০ বিঘা জমিতে মুগডাল চাষ করা হয়। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২০
এমআরএম/এফএম