ঢাকা : শৈশবে পন্ডিত স্যারের মুখে শুনেছিলাম, ‘মলদ’ নামে এক প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর নাম থেকে ‘মালদহ’ বা ‘মালদা’ নামটি এসেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সোনা মসজিদ চেকপোস্ট হয়ে মালদহ যাওয়া সহজ।
র্যাডক্লিফ রোদেদাদের রায়ে এই জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, নাচোল ও গোমস্তাপুর থানা বাদে বাকি অংশ ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
মালদার উত্তরে বিহারের পূর্ণিয়া জেলা এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা, পূর্বে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ জেলা ও রাজশাহী। পশ্চিমে বিহার ও ঝাড়খন্ড রাজ্য।
মালদহের প্রধান শিল্প-রেশম ও ফল প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। দর্শনীয় বিভিন্নস্থান-সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাংকের আমল থেকে শুরু। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে যে গৌড় ছিল বঙ্গের রাজধানী- সেটি এখন মালদহ শহরে থেকে ২১ কিমিঃ দূরে একটি ছোটো গ্রাম মাত্র।
এখানে দেখার জায়গাগুলো হলো- বড়ো সোনা মসজিদ, ফিরোজ মিনার, দাখিল দরওয়াজা, লুকোচুরি গেট, কদমরসুল, চিকা মসজিদ, চামকাট্টি মসজিদ, তাঁতিপাড়া মসজিদ ও লোটন মসজিদ।
আদিনা শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো হলো- বিশাল আদিনা মসজিদ, সালামি দরওয়াজা, জামি মসজিদ, ছোট দরগা, ছোট সোনা মসজিদ, একলাখি সমাধি। বড় সোনা মসজিদের অদূরে রয়েছে শ্রীচৈতন্য দেবের স্মৃতি বিজড়িত রামকেলি গ্রাম।
এখানের সরোবরগুলো দেখার মতো। গঙ্গা, কালিন্দী, মহানন্দা, টাঙ্গন, নাগর আর পুনর্ভবা নদী বয়ে গেছে এই জেলার মধ্য দিয়ে। মালদহ জেলায় মহকুমা ২টি- মালদহ সদর ও চাঁচল। জনসংখ্যা ৩,৯৯৭,৯৭০ জন। মালদহ জেলার আয়তন ৩,৭৩৩ বর্গ কিমিঃ।
মালদহের আম ও আনারস স্বাদের জন্য বিখ্যাত। মালদহের উল্লেখযোগ্য স্থানÑ ইংরেজ বাজার, গাজোল, হরিশচন্দ্রপুর, আড়াইডাঙ্গা, রতুয়া, মালতীপুর, বুলবুলি চাঁদি, পাকুয়া, বামনগোলা, ভগবানপুর, কালিয়াচক।
মালদহের থানাগুলো হলোÑ বামনগোলা, বৈষ্ণবনগর, চাঁচল, ইংরাজবাজার, গাজোল, হাবিবপুর, হরিশচন্দ্রপুর, কালিয়াচক, মানিকচক, মালদহ ও রতুয়া।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ চেকপোস্ট হয়ে বাস ধরে গেলাম মালদহে। ওখানে গিয়ে উঠলাম ট্যুরিস্ট লজে। রুমে বিছানায় শুয়ে আছি- তখনই রুমে প্রবেশ হোটেলের একজন কর্মীর। তার সঙ্গে আলাপ করে মালদহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারলাম।
তিনি বললেন, মালদহের দক্ষিণে গৌড় আর উত্তরে পান্ডুয়ার অবস্থান। এই দুই জায়গা দেখে নেবেন কিন্তু।
বললাম, মালদহে এসেছি তো অতীত কীর্তি দেখবার জন্যই। এখানের মধ্যযুগীয় ধ্বংসাবশেষ এখনও যে পর্যটকদের আকর্ষণ করে চলেছে।
মালদহ শহরটি আজকের নয়। ১৭৭০ সালে গৌড় ও পান্ডুয়ার মাঝে রেশম কারবারের সুবিধার্থে ছোট্ট এক গ্রাম কিনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কুঠি গড়ে। নাম হয় তার ইংরেজাবাদ অর্থাৎ ইংরেজের আবাদ।
কালে কালে ইংরেজাবাদই হয় ইংলিশ বাজার। ব্যবসার স্বার্থে তাঁতী ও মসৎজীবিরা এসে বসতি গড়ে তোলে কুঠি ঘিরে। ১৭৭১ সালে কুঠি থেকে দুর্গ গড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অর্থাৎ ব্রিটিশ।
১৯৩৭ সালে জন্ম মালদহ মিউজিয়ামের। এখানে রয়েছে গৌড় ও পান্ডুয়ার প্রতœতত্ত্বের নানা সংগ্রহ। এসব ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
জানলাম, মালদহ রেলস্টেশনের চত্বরে একটি পার্ক আছে। সান্ধ্য ভ্রমণের মনোরম পরিবেশ রয়েছে ওখানে। সন্ধ্যার পরক্ষণে এলাম এই পার্কে।
হঠাৎ কানে ভেসে এলোÑ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি/চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি/ ...গানের কথাগুলো। চেয়ে দেখি সেই কৃষ্ণ এ গান গেয়ে চলছে। একটু পরেই আমাকে দেখেই দৌড়ে এলো কৃষ্ণ।
জড়িয়ে ধরে বললো, দেখুন দাদা, আপনার সঙ্গে আমার কতোই না মিল ...। আমাদের পশ্চিমবাংলার যে শহরে আসেন সেখানেই তো দেখা হয়ে যায়। আমি কৃষ্ণ, বাঙালির ঘরে ঘরে ঘুরবো। রবীন্দ্রনাথের গান গাইবো, বলুন কী গাইবো?
বললুম, তাতো আমি জানি না।
জানতে হবে! এ কথা বলেই কৃষ্ণ গান ধরলোÑ এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী/ ওরে রে ওরে মাঝি, কোথায় মাঝি, প্রাণপণে, ভাই, ডাক দে আজি/ তোরা সবাই মিলে বৈঠা নে রে, খুলে ফেল সব দরাদড়ি/ দিনে দিনে বাড়ল দেনা, ও ভাই, করলি যে কেউ বেচাকেনা ...।
গানখানি শুনে কৃষ্ণর পানে তাকিয়ে রইলাম। লোকজনও ওর গানে মুগ্ধ। বললুম, চলো আমার ওখানে থাকবে। বললো, কালকে গৌড়ে আসুন, ওখানেই দেখা হবে। কত কথা হবে।
জনশ্রুতি- অতীতে গুড় ব্যবসার প্রসিদ্ধির জন্য গুড় থেকে গৌড় নামকরণ। তবে পুরাণে মেলে সূর্যবংশীয় রাজা মান্ধাতার দৌহিত্র গৌড় এই ভূখন্ডের রাজা ছিলেন। বাংলাদেশের সীমান্তে এই গৌড়ে এলাম ট্যাক্সিতে।
গৌড়ের পাশেই মহদীপুর। এই মহদীপুর হলো চেকপোস্ট। ট্যাক্সিতে এসে নামলাম পিয়ামবাড়িতে। ওখান থেকে রিকশায় চললাম গৌড়ের দিকে। রিকশা থেকে নেমেই পরিচয় হলো এক গাইডের সঙ্গে। এবার তার সঙ্গে চললাম গৌড় দেখতে।
গাইড জানালেন, ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে সামন্ত রাজ শশাংক গৌড় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর সেন বংশের শাসনে ছিল গৌড়। তবে ১২ শতকে বখতিয়ার খিলজীর দখলে যায়। আর বর্তমানে মালদহ থেকে ১৬ কিমিঃ দূরে ঐতিহাসিক পরিবেশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রায় ৫৫০ বছরের পুরনো প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে।
গাইডের সঙ্গে এবার এলাম বড় সোনা মসজিদের কাছে। দেখলাম, এখানে এগারোটি দরজা। মাথায় রাজকীয় গম্বুজ।
গাইড জানালেন, সুলতান নূসরত শাহ ১৫২৬ সালে এই বড় সোনা মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। গৌড়ের সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি। খোদাই ভাস্কর্যে গ্রিক ও আরবী সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। এর অদূরেই বিধ্বস্ত দাখিল দরওয়াজা ও ফিরোজ মিনার।
ফিরোজ মিনারের কাছে এসে দাঁড়ালাম। বারবার দেখছি, দেখার আকাঙ্খা তবুও যে মিটছে না। ওখান থেকে এলাম কদমরসুলে। এখানে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র চরণচিহ্ন রয়েছে। এর পাশাপাশি টেরাকোটা কাজ করা তাঁতিপাড়া মসজিদ। দেখলাম, মীনা করা ইটে তৈরি লোটন মসজিদ ও চিকা মসজিদ।
গাইডের কথায় পূর্ব দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, এ পথ গেছে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। আর এ পথে পাগলা নদীর সাঁকো পেরিয়ে গুণমন্ত মসজিদ ও চামকাঠি মসজিদ ছাড়াও কোতওয়ালি দরজা দেখা যাবে। চলুন ওইদিকে পা বাড়াই।
চামকাঠি মসজিদটি দেখিয়ে গাইড জানালেন, এটি তৈরি করেন সুলতান ইউসুফ শাহ। সম্ভবতঃ ১৪৭৫ সালে এটি তৈরি করা হয়। সুলতান ইউসুফের আর এক কীর্তি হলো- ফজলি আম সৃষ্টি।
সুলতান ফজল বিবিকে নিবাস গড়ে দেন আম্রকাননে। বিলাসব্যসনে মগ্ন হয়ে পড়েন বিবি সাহেবা। ফজল বিবির আবাস লাগোয়া কাননের কোন এক বৃক্ষে আমও ফলতো বিপুল আকারের। লোকে বলতো ফজল বা ফজলি আম। ফজল বিবি আজ আর নেই। তবে ফজলি আম আছে গাছে গাছে বিপুলহারে।
পরদিন সকালে রওয়ানা দিলাম পান্ডুয়ার দিকে। পান্ডুয়াও ছিল অতীতকালে বাংলার রাজধানী। সেই সব মুসলিম শাসকদের কীর্তিকলাপের নানা ধ্বংসাবশেষ আজও অতীত রোমন্থন করায়। আগে এর নাম ছিল পান্ডুনগর। সম্ভবতঃ মহাভারতের পান্ডব রাজার রাজত্ব ছিল সেকালে। আজও পান্ডবরাজ দালান আছে।
পান্ডুয়াতে গিয়ে দেখলাম- বড় দরগা। মূল সড়কেই এর অবস্থান। ১৪৫৮ সালে দরগাহ গড়েন সুলতান শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ। পানির ওপর দিয়ে গঙ্গা পার ছাড়াও সৈয়দ শাহ‘র নানা অলৌকিক ঘটনায় মুগ্ধ হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেন দরগা শরীফের পাশে জুমা মসজিদটি গড়ে তোলেন।
ফকির সাহেবের ব্যবহৃত নানা জিনিস রয়েছে মসজিদে। আর আছে উত্তরে নবাব সিরাজদ্দৌলার হাতে রূপোর বেষ্টনীতে ঘেরা ফকির সাহেবের আসন তথা চিল্লাখানা, ভান্দুরখানা, চাঁদ খানের সমাধি, হাজী ইব্রাহিমের সমাধি এবং নানা বাড়ি-ঘর, দরগা শরীফ।
পা-ুয়ায় আরও দেখলাম সালামী দরওয়াজা, বড় দরগাহ, ছোট দরগাহ, একলাখি মসজিদ, কুতুব শাহী মসজিদ ইত্যাদি।
এদিকে দুপুর হয়ে এসেছে। পথে দেখা হয়ে গেল একজন বৃদ্ধের সঙ্গে। মুসলিম এই ভদ্রলোকটি দেখতে একজন দরবেশের মতো। দু’চারটি বাক্য বিনিময় হতেই তিনি বললেন, চলুন, আদিনা মসজিদ দেখবেন। আদিনা মসজিদ পান্ডুয়ার অন্যতম দ্রষ্টব্য।
এটি ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দর শাহর হাতে শুরু হয়ে পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর হাতে ১৩৬০ সালে সমাপ্ত হয়। এটি আজও মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হয়ে অতীত কীর্তন করছে। এখানে প্রাচীর গাত্রে কুরআনের বয়াত লেখা আছে।
উনি বললেন, আমার নাম আশরাফ আলী। বাবার নাম সোহরাব আলী। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। তবুও আমরা মুসলমান হয়ে পা-ুয়া ছেড়ে পাকিস্তানে যাইনি।
মুসলিম কীর্তি ফেলে রেখে চলে যাবোÑ এটা কখনও যে ভাবেননি আমার পূর্ব পুরুষরা। আমিও ভাবি না। যতোদিন বেঁচে থাকবো এই পান্ডুয়া আর আদিনায় থেকে যাবো। এ কথাগুলো শুনে বৃদ্ধ আশরাফ আলীর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
উনি বললেন, কিছু বলার আছে ...?
বাংলাদেশ সময় : ১৬০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১২
সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর
[email protected]