ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ

রেলিংয়ে দাঁড়াতেই চোখ চলে গেলো কীর্ত্তনখোলার পাড়ে। ভোরের আলো ফুটেছে বেশিক্ষণ হয়নি। আড়মোড়া ভাঙছে সাদা হাঁসের দল। প্রশস্ত সফেদ ডানায় কুয়াশা তাড়াচ্ছে যেনো!

এম ভি মধুমতি (ঢাকা-খুলনা) থেকে: রেলিংয়ে দাঁড়াতেই চোখ চলে গেলো কীর্ত্তনখোলার পাড়ে। ভোরের আলো ফুটেছে বেশিক্ষণ হয়নি।

আড়মোড়া ভাঙছে সাদা হাঁসের দল। প্রশস্ত সফেদ ডানায় কুয়াশা তাড়াচ্ছে যেনো!

মেঘনার পর জাহাজ তির তির করে এগিয়ে চলেছে কীর্ত্তনখোলার বুক চিরে। এর আগে, রাতের চিত্রনাট্যের অধিকাংশই ছিলো মেঘনার দখলে। শ্রেষ্ঠাংশে আরও ছিলো- কৃষ্ণপক্ষ দ্বিতীয়া চাঁদ, রাতের তারা আর ডেকে ভিড় করা সারি সারি কালো মুখ। মেঘহীন নিশুতি রাতের আকাশতলে চেহারাগুলো ঠিকমতো নজরে আসে না কিন্তু মনের ভেতরটা বোধহয় পড়ে ফেলা যায়। এরপর একে একে কেবিনের লাইটগুলো নিভে এলেও বিশেষ চরিত্রে জেগে থাকে জেলে নৌকার লণ্ঠন। ঘুমের ঘোরেও বুকে এসে লাগে প্রমত্তা মেঘনার ধাক্কা। উত্তুরে হাওয়ায় জাহাজের দুলুনি ঘুমের দেশ পার করে এক ঝটকায় নিয়ে যায় সকালের স্নিগ্ধতায়।
ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ চারদিকে ছড়াতে শুরু করেছে মিঠে রোদ। দুইপাশের মাঠঘাট, ক্ষেত, গেরস্থ বাড়ির উঠান, নারকেল-সুপারি গাছের ঠিকানায় মুগ্ধতার চিঠি বিলি করতে করতে এগিয়ে চলি।
 
রাতের জেলেরা জাল গুটিয়ে চলে গেছে আগেই। সাতসকালে দিনের জেলেরা যতো সাদা ফাঁস জাল ছড়িয়ে দিচ্ছে নদীর জলে, ততোই যেনো কমছে কুয়াশার চুনরঙ।
ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ বেলা বাড়ে। জাহাজও এগিয়ে চলে সুগন্ধার জল কাঁপিয়ে। সময়ের ব্যবধানে জাহাজ ভেড়ে ঝালকাঠি, কাউখালী ঘাটে। কেউ নামবে, কেউ উঠবে। সামনে হুলারহাট, চরখালী ঘাটের হাতছানি।
ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ নদীপাড়ের গ্রামগুলো জাগার সঙ্গে সঙ্গে জাগতে শুরু করে জাহাজযাত্রীরাও। গাঁয়ের বঁধুদের সকাল শুরু হয়ে গেছে আরও আগেই। রোজকার ও শীতের কাপড় মেলে দিয়েছে বাড়ির বেড়ায়। মিঠে রোদের ওম জমা করে তুলে রাখবে রোদের তীব্রতা বাড়ার আগেই। বাড়ির সামনে শিম-কুমড়োর মাচা। কুমড়ো লতার সঙ্গে সঙ্গে রোদ পোহায় গাঁয়ের লোকসহ জাহাজের যাত্রীরাও।
ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ বিষখালীর বাঁকে মৃত ধানসিঁড়িকে হাত নেড়ে জাহাজ ঢোকে গাবখান চ্যানেলে। চেনা কেউ দেখিয়ে না দিলে, খোদ জীবনানন্দও আবার ফিরে এসে তার প্রিয় ধানসিঁড়িকে চিনতে পারবেন কিনা সন্দেহ!
 
স্রোত হারিয়ে ধানসিঁড়ি কার‌্যত এখন মৃত। শুকনো মৌসুমে স্টিমার-লঞ্চ তো দূরের কথা, নৌকাও চলে না। মাছের লোভে উড়ে আসে না সোনালি ডানার চিল।  
ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ এদিকে, দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে খুলনা বন্দরের দূরত্ব কমাতে ১৮০০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে গাবখান চ্যানেল খনন করা হয়। মংলা বন্দরের সঙ্গে দূরত্ব কমে যায় বরিশালসহ চট্টগ্রাম বন্দরের। তখন থেকেই এর নাম হয়ে যায় বাংলার সুয়েজ। স্থানীয় উচ্চারণে যাকে বলা হয় সুইস।
 
চরখালী ভিড়তেই কেবিনের সামনে দিয়ে হোগলাপাতার জায়নামাজ, শীতলপাটি ফেরি করে ফেরেন ধর্মপ্রাণ বয়ঃজ্যেষ্ঠ আসলাম উদ্দিন। তার হাঁকে খেয়াল হয়, চ্যানেলের দু’পাশে জোয়ারের পানিতে বেশ খানিকটা ডুবে রয়েছে হোগলা গাছের ছোট ছোট ঝোপ। আরও অনেক কিছুর মতো এটি শীতল পাটিরও দেশ। এই হোগলায় শত শত বছর ধরে শীতল পাটি বুনে আসছে ধানসিঁড়ি তীরের গ্রাম হাইলাকাঠি ও এর আশপাশের মানুষ। এখনও এ গ্রামের কয়েকশো মানুষের জীবিকা শীতল পাটি বোনা।
ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ কচা নদীতে ঢুকতে ঢুকতে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশ ছোঁয়। গ্রাম্যবাজারগুলোতে ততোক্ষণে জমজমাট অবস্থা। রোজকার ব্যস্ততার পারদ চড়েছে। ঘাটগুলোতেও ‘হেইয়ো হেইয়ো, আগে চলো, হেইয়ো’ রব। দূর-দূরান্ত থেকে ভিড়ছে ছোট ছোট মালবাহী ট্রলার। কেউ সদাইপাতি নেওয়া শেষে খুলছে ঘাটের দড়ি।
 
নদীতে জোয়ারের টান। কচুরিপানা ভেসে আসার তীব্র গতি দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, অচিরেই দেখা দেবে বলেশ্বর নদী। এরপর কচা আর বলেশ্বর মিলে আরও প্রশস্ত নদী হয়ে আমাদের নিয়ে যাবে শরণখোলা, ঘষিয়াখালী হয়ে পশুর।
ছবি: শুভ্রনীল সাগর- বাংলানিউজ দুই নদীর মিলিত জলের স্রোত কেটে কেটে ফেলে আসা লালকুঠি, চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী, হুলারহাট, চরখালীর মতো মাছুয়া ঘাটেও গল্প রয়ে যায়। দিনপঞ্জি বলছে, আজ ১৬ ডিসেম্বর- মহান বিজয় দিবস। পৌষের বাতাসে একটু বেশিই যেনো মাথা উঁচু পতাকা উড়িয়ে চলেছে এম ভি মধুমতি।
 
দূর থেকে জোহরের সুমিষ্ট আজান ভেসে আসে। এইসব দিনরাত্রির গল্প রয়ে যায় ফসলি জমির আলপথ, শিশির জড়ানো খেজুর গাছ আর ঢেউয়ের ঘ্রাণে।

** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
এসএনএস/এসআরএস/

সহযোগিতায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।