তাদের কজনের কথোপকথন ছিল ঠিক এ রকম: -‘দোস্ত, একসাইটেড আমি। সকালে ফুল দিবো,’
-‘প্রাইজ কত হবে ফুলের’, অন্যজনের প্রশ্ন।
-‘রিজেনেবল’, প্রতিউত্তরে আরেক বন্ধু।
-‘লাগবে না রে; আমাদের রুফটপে কিছু গোলাপ আছে আমি তোদের জন্য নিয়ে আসবো’।
-‘জোস,’ প্রায় প্রত্যেকের কণ্ঠ মেলানো!
দুই-এক বাক্যের আলাপে চার থেকে পাঁচটি ইংরেজি শব্দে কথোপকথন কানে আর খটকা না লাগালেও, মনে তো খটকা জাগাতে পারে। কিন্তু সেটিও বুঝি এখন আর হয় না। আর আট-দশজন বাদ; সদ্য স্কুল শেষে ফেরা শিশুরাও কতটা ইংরেজি আসক্ত! সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণে যদি গুরুচণ্ডালী দোষ হতে পারে, তবে বাংলার সঙ্গে ইংরেজির মিশ্রণ আদৌ কোনো দোষে পড়ে না!
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবারগুলোতেও ভাষা চর্চার ছাপ কার্যত অদৃশ্যই। বায়ান্নে একুশ অর্জনের পরও এটাই কি আমাদের সতেরোর একুশের হালচাল নয়!
মিশ্রণে বাংলা বলা আর সচেতনভাবে মাতৃভাষার প্রয়োগে উদাসীনতাকেই দুষছেন ভাষাবিদরা। আজ ৬৫ বছর পরে রক্তে কেনা ভাষা নিয়ে এমন উদাস-উদাসী মনোভাব সত্যিই কপালে ভাঁজ ফেলে। শিক্ষা, তথ্য এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে এনিয়ে এগিয়ে আসতে হবে; কাজ করতে হবে যৌথভাবে। পাশাপাশি অতি দ্রুত প্রণয়ন করা উচিত ভাষানীতি, মত দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার।
ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এক প্রবন্ধে উঠে এসেছে- তিনি বলছেন, সংবিধানে ভাষানীতির মূল ভিত্তি রচিত হলেও ভাষা-পরিকল্পনার অভাবে তা কার্যকর হতে পারছে না। এই পরিকল্পনায় ভাষার প্রাণশক্তি বিবেচনা করা উচিত। দেশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলেন; সর্বোচ্চ মর্যাদাই বাংলারই প্রাপ্য।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপরে ২০০০ সাল থেকে ১৮৮টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে।
একুশ নিয়ে হয়ত সেখান থেকেই এগিয়ে যাওয়ার মসৃণ পথ রচিত হতে পারতো, কিন্তু তারপরও কি একুশের চেতনা বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকেনি দেশ? স্বাধীন বাংলায় শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একুশ নিয়ে কাজের ব্যাপকতা আরো বাড়তেই পারতো। ‘বাংলার’ টানেই বাংলাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বে প্রজন্মের তারুণ্য কিছু একটা করতে পারতো, যদিও এখনও পারে। কিন্তু বাস্তবে সেভাবে হয়নি বলেই বুঝি সতেরোর একুশ আর বায়ান্নর একুশের মধ্যে ফারাক বাড়ছে।
জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ কিংবা কিছু কিছু চলচ্চিত্রে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে স্বল্প ধারণা এসেছে মাত্র। স্বাধীন বাংলার পরও পূর্ণাঙ্গভাবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো ছবি নির্মিত হয়নি। তবে এ সময়ের অনেক নির্মাতারাই ’৫২ নিয়ে ছবি নির্মাণে আগ্রহী। এ ধরনের কাজে অনেক বেশি লগ্নি দরকার; আর অর্থ ছাড়ে আগ্রহী নন প্রযোজকরাও, সেটিও একটি বাধা।
পাশাপাশি ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণার পথ আজ অনেকটাই সংকুচিত। একুশের চেতনায় বইমেলা হলেও নেই উন্নতমানের বই প্রকাশের উদ্যোগ, এই বিরাট কাজে পিছিয়ে বাংলা একাডেমিও (ভাষা আন্দোলন, জেলায় জেলায় ভাষা আন্দোলন, শহীদদের জীবনী বই, তাদের আন্দোলনের পটভূমি)। তবে কি নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের পাঠ কি শুধু পাঠ্যবইয়ের দুই-এক পৃষ্ঠার মধ্যেই আটকা!
ইতিহাসের পাতায় পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। সারা বিশ্বের কোটি কণ্ঠে আজ উচ্চারিত হচ্ছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’।
১৯৫২’তে ঢাকার রাজপথে ঘটেছিল বাঙালির ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার ঘটনা। ‘বাংলা ভাষা, প্রাণের ভাষা’ স্লোগানে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় বাঙালি তরুণ প্রজন্ম।
ইতিহাসবিদদের মতে, ভাষার প্রশ্নে একুশের আন্দোলন হলেও প্রকৃত পক্ষে তা ছিল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ। সেদিন আত্ম-অধিকার, সমতাভিত্তিক সমাজ আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্নে জেগে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। একুশের আন্দোলনেই ঘটে বাঙালির আত্মবিকাশ, যার ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে এসেছে মহান স্বাধীনতা।
কিন্তু স্বাধীন বাংলায় দিন শেষে প্রশ্ন থেকেই যায়, কতটুকু মর্যাদা কিংবা শুদ্ধ ব্যবহারে প্রিয় বাংলাকে আগলাতে পারছি? তবুও ‘একুশ মানে মাথানত না করা’, আবুল ফজলের মতো এমন প্রত্যয়েই একুশের শুভ সকাল।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
আইএ