১৭৫৭ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে (৫ জুন) চুক্তি স্বাক্ষরের পর কলকাতাস্থ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শীর্ষ সংস্থা সিলেক্ট কমিটি পরিকল্পিত ‘বিপ্লব’, ‘বিদ্রোহ’, ‘পরিবর্তন’ বাস্তবায়নের জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে (২৩ জুন) সেটিকে সফলভাবে সমাপ্ত করতে সক্ষম হয় ইংরেজরা।
ষড়যন্ত্র পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করে সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে ১১ জুন কলকাতায় ইংরেজরা বৈঠকে বসে। সরাসরি মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হওয়া সর্বোত্তম হবে, না মীরজাফরের কাছ থেকে আরও পরামর্শ ও অভিযান পরিচালনার কৌশল বিষয়ে জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, এই ছিল আলোচ্য বিষয়। সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে, ‘বর্তমান সন্ধিক্ষণে সর্বোত্তম সুবিধাজনক কাজ হবে মীরজাফরের পক্ষে বিপ্লব বাস্তবায়িত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। ’ কেননা, আরও বিলম্ব হলে নবাবের কাছে ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে যাবে এবং মীরজাফরকে সরিয়ে দেওয়া হবে। ফলে ব্রিটিশের গোটা পরিকল্পনা ভণ্ডুল হবে। ব্রিটিশরা সাহায্যকারী বিহীন ও একাকী হয়ে পড়বে। নবাব সিরাজকে মোকাবেলা করা তখন তাদের পক্ষে সহজ ও ফলপ্রসু হবে না।
অতএব কলকাতা থেকে ১৩ জুন ক্লাইভ সসৈন্যে মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ১৯ জুন ক্লাইভ কাটোয়ায় পৌঁছান। স্থানটি আগের দিন অগ্রবর্তী ইংরেজ বাহিনীর কর্নেল কুট নবাবের সৈনদের কাছ থেকে দখল করে নেন। ২১ জুন ক্লাইভ ‘সমর পরিষদ’-এর ফিল্ড সভা আহ্বান করেন। সভায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে ধীরে চলার নীতি অনুমোদিত হয়। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে ক্লাইভ অচীরেই এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং পরদিন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে আরও অগ্রসর হতে থাকেন। ২২ জুন ব্রিটিশ বাহিনী ক্লাইভের নেতৃত্বে পলাশীর পথে যাত্রারম্ভ করে। ২২ তারিখই দুপুরের পর পর ক্লাইভ নবাব শিবির থেকে মীরজাফরের পাঠানো দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত বার্তা পান। বার্তার মর্মোদ্ধার করে কৌশলী ক্লাইভ তার যুদ্ধযাত্রা অব্যাহত রেখে রাতের মধ্যেই এক প্রকারের বিনা বাধায় পলাশীর প্রান্তরে এসে উপস্থিত হন। অপরদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলাও ইংরেজ সৈন্যের যুদ্ধ প্রচেষ্টা সম্পর্কে অবহিত হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে সৈন্য-সামন্তসহ ২২ তারিখেই পলাশীতে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। পলাশীতে তখন মুখোমুখি দুই পক্ষ।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আবদুল হাদি খান, নবসিং হাজারি প্রমুখের নেতৃত্বে নবাবের সৈনরা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালায়। পক্ষান্তরে, মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভরামের অধীনস্থ নবাবের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেনা নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। পরিস্থিতি অবলোকন করা ছাড়া তারা আর কিছুই করে নি। এমন কি, কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধেও চূড়ান্ত কিছু ঘটছে না দেখে ষড়যন্ত্রকারীরা বিস্মিত হয় এবং ইংরেজদের বিজয়ী করার পন্থা উদ্ভাবনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
মীরজাফর প্রমুখের আশ্বাসে স্বয়ং ক্লাইভও আশ্বস্ত ছিলেন যে সহজেই যুদ্ধ জয় সম্ভব হবে। কিন্তু নবাব সেনাদের পক্ষে এতো প্রবল আক্রমণে ক্লাইভ দিশেহারা হয়ে যান। কোনও রকমে দিনের বেলাটা যুদ্ধ করে রাতের অন্ধকারে ক্লাইভ কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিন্তু বেলা তিনটার দিকে অকস্মাৎ যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় প্রথমে আকস্মিক বৃষ্টিতে নবাবের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে। কিছুক্ষণ পরেই যখন কামানের গোলায় মীর মর্দান আঘাত প্রাপ্ত ও নিহত হন, নবাবের যুদ্ধরত ক্ষুদ্র অংশটিও দুর্বল হয়ে পড়ে। নবাব পক্ষ তখন কিছুটা হত-বিহ্বল ও শোকাক্রান্ত। এহেন পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষ থেকে ইংরেজদের প্রতি হামলার তীব্রতাও স্বাভাবিক কারণেই কমে যায়। ফলত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে অবস্থিত ক্লাইভের শিবিরে নেমে আসে স্বস্তি।
যুদ্ধ-পরিস্থিতি নিয়ে নবাব তার সেনাপতিদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন এবং নিষ্ক্রিয় সৈন্যদের সক্রিয়ভাবে ইংরেজ শিবিরে আঘাত হানার জন্য নির্দেশ দেন। তিনি মীরজাফরকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য। নবাব গভীর আবেগে মীরজাফরের কাছে দেশ ও শাসনের সম্মান রক্ষা করার আবেদনও করেন। কিন্তু মীরজাফর কপট আনুগত্যে উদভ্রান্ত নবাবকে বশ করে ফেলেন এবং এহেন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিরতি দিয়ে পরদিন নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করার ভ্রান্ত প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে দেন। নবাব সরল মনে মীরজাফরের পরামর্শ মেনে নেন।
মীরজাফরের চাপিয়ে দেওয়া এই সিদ্ধান্ত নবাবের সৈন্যদলকে আরও হতোদ্যম করে। মাত্র কয়েক গজ দূরে অবস্থিত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো কোণঠাসা ইংরেজ বাহিনীকে ছেড়ে দিয়ে তারা ফিরে আসতে বাধ্য হয়। ক্রমেই তারা শোক ও সিদ্ধান্তহীনতায় অসংঘটিত হয়ে পড়ে। ক্লাইভের কাছে নবাব পক্ষের যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত তাড়াতাড়িই পৌঁছে যায়। তার মতো যুদ্ধ কৌশলীর কাছে এ খবরের তাৎপর্য ও গভীরতা অবোধগম্য হওয়ার কথা নয়। কালবিলম্ব না করে ক্লাইভ মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে এলোমেলো নবাব শিবিরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অল্পক্ষণ পরেই নেতৃত্বহীন নবাব সৈন্য বিশৃঙ্খলতার শিকার হয় এবং যত্রতত্র পালিয়ে যায়। অপরাহ্ন পাঁচটার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে তখনই অরক্ষিত রাজধানী মুর্শিদাবাদ দখলের জন্য এগিয়ে যেতে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে, এটা হল এমনই এক বিশিষ্ট ও চূড়ান্ত যুদ্ধ, যেখানে কোনও ব্যাপক আক্রমণ ও প্রতিরোধ ছাড়াই বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে রাজ্য জয় করা সম্ভব হয়েছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত লড়াই-এ শুরুর দিকের কয়েক ঘণ্টা মাত্র কিছুটা যুদ্ধ হয়েছে এবং সেটাও নবাবের বাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে। বাকী সময় নবাবের চক্রান্তকারী সেনাপতিরা সময় ক্ষেপন করে এবং ইংরেজ সৈন্যদের শক্তি সঞ্চয় করতে ও বিজয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সাহায্য করে। বিকাল তিনটা থেকে চারটার মধ্যে সংগঠিত হয়ে ইংরেজ সৈন্য বিশৃঙ্খল নবাব বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে ময়দান দখল করে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ নয়, ইংরেজরা তাদের ষড়যন্ত্র কৌশলে এবং নবাব শিবিরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পলাশীতে বিজয়ী হয়। নবাবের পরাজয় ছিল রাজনৈতিক, সামরিক নয়। রাজনৈতিক ও কৌশলগত ব্যর্থতার কারণে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার পূর্ণ সামরিক শক্তি ব্যবহার করার সুযোগ পান নি।
ইতিহাসের পাতায় সুদূরপ্রসারী ছাপ এবং পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাট বড় প্রভাববিস্তারী পলাশীর যুদ্ধ তাই ছিল যুদ্ধের নামে তামাশা। পলাশীর রণাঙ্গনে উভয় পক্ষের ক্ষয়-ক্ষতির চিত্রটি পর্যবেক্ষণ করলে কোনও ভয়াবহ সমরের চিত্র পাওয়া যায় না। কারণ, পলাশীর পাঠে প্রকাশ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলা মুখোমুখি হলেও গোপনে অনেক কিছু হয়েছে। নবাবকে সমর্থন করেছে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর ইংরেজ কোম্পানিকে সাহায্য করেছে নবাবের কয়েকজন সেনাপতি। ইংরেজ পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয় রবার্ট ক্লাইভ, মেজর কিলপ্যাট্রিক, মেজর গ্র্যান্ট, মেজর আইরি কুট, ক্যাপ্টেন গপ ও ক্যাপ্টেন রিচার্ড নক্স। নবাবের পক্ষে ময়দানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং সিরাজউদ্দৌলা এবং মোহনলাল (প্রধান সেনাপতি), মীর মদন (ভ্যানগার্ড), মীরজাফর (অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান ও বিশ্বাসঘাতক), খুদা-ইয়ার লুৎফে খান/ইয়ার লতিফ (বিশ্বাসঘাতক), রায় দুর্লভ (বিশ্বাসঘাতক) ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রে (অস্ত্রাগার)।
শক্তিমত্তার বিবেচনায় ইংরেজের পক্ষে ছিল ১,০০০ ইউরোপীয় সৈন্য, ২,১০০ ভারতীয় সৈন্য, ১০০ বন্ধুকবাজ ও ৯টি কামান। পক্ষান্তরে নবাবের পক্ষে ছিল ৫০,০০০ সৈন্য এবং ৫৩টি কামান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, নবাবের পক্ষে মাত্র ৫,০০০ সৈন্য যুদ্ধে অংশ নেয় এবং সিংহভাগই নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে। ফলে ৫/৬ হাজার লোকের মারামারিকে যুদ্ধ বলা যায় না; বরং যুদ্ধের নামে তামাশা বলাই সঙ্গত। ষড়যন্ত্র এতোটাই নিখুঁত ও গভীর ছিল যে, বিরাট বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও চক্রান্তকারীদের কাছে নবাবকে পরাজিত হতে হয়।
পলাশীর মাঠে কিরূপ হাস্যকর তামাশা হয়েছিল যুদ্ধের নামে, সে প্রমাণ পাওয়া যায় ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণে। এতো বড় যুগান্তকারী রণাঙ্গনে কোম্পানির পক্ষে ৭ জন ইউরোপীয় ও ১৬ জন দেশীয় সৈন্য মিলে মাত্র ২২ জন নিহত হয়। ১৩ জন ইউরোপীয় ও ৩৬ জন দেশীয় মিলে আহত হয় মোটে ৫৩ জন সৈন্য। নবাব সিরাজের পক্ষে আনুমানিক ৫০০ সৈন্য আহত-নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ক্লাইভ বাহিনীর হাতে বিনা প্রতিরোধে একতরফাভাবে মারা যায় বা বলা যায়, ক্লাইভের গণহত্যার শিকারে পরিণত হয়।
পলাশীর মারাত্মক বিপর্যয়ে হতবিহ্বল না হয়ে নবাব সিরাজ ২,০০০ সৈন্যসহ রাজধানী রক্ষার জন্য মুর্শিদাবাদ অভিমুখে রওয়ানা দেন। কিন্তু তার সেনাপতিদের কেউ তাকে সাহায্য করে নি। বরং তারা ক্লাইভের সঙ্গে মিশে বিজয় উপভোগের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নীরব ও বন্ধুহীন রাজধানীতে থাকা সমীচিন মনে করলেন না নবাব। তিনি সহধর্মিনী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান। এবং সেখান থেকে নৌকা যোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তার আশা ছিল মুক্তাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সেনাপতি মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রাজা রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে শত্রুমুক্ত করবেন।
স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের আশা সিরাজের সফল হয় নি। পথিমধ্যে তিনি মীরজাফরের নিষ্ঠুর পুত্র মিরনের হাতে বন্দি হন এবং বন্দি অবস্থাতেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সিরাজকে হত্যার কাজে নিযুক্ত করা হয় সিরাজেরই আশীর্বাদ-প্রাপ্ত মোহাম্মদী বেগ নামক একজনকে দিয়ে। মোহাম্মদী বেগ কৃতজ্ঞতার বদলে চরম নিষ্ঠুরতা ও অকৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটিয়ে ইতিহাসে নিন্দিত হয়ে রয়েছে।
পরবর্তী পর্ব
পলাশী-পরবর্তী নির্যাতন-মিথ্যাচার
পূর্ববর্তী পর্ব
বাংলার আকাশে ঘনীভূত অন্ধকার
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৭
জেডএম