পলাশীর বিপর্যয়ের পর পরই সিরাজের পরিবার ও অনুগতদের প্রতি নেমে আসে চরম নির্যাতনের নিষ্ঠুর আঘাত। চলতে থাকে হত্যা, গুপ্তহত্যা, আটকের নির্মম ধারা।
সিরাজকে হত্যার পর তদীয় পত্নী লুৎফুন্নেসাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। নবাব সিরাজের সঙ্গে তিনিও ধরা পড়েছিলেন তার একমাত্র কন্যা উম্মে জোহরাসহ ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন। ধরা পড়ার পর লুৎফুন্নেসার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। মুর্শিদাবাদের জেলখানায় ধারাবাহিক নির্যাতনে তিনি মৃত-প্রায় হয়ে যান। ১৭৫৮ সালে কন্যাসহ বন্দি বেগম লুৎফুন্নেসাকে ঢাকায় পাঠিয়ে বন্দি করে রাখা হয় জিঞ্জিরা প্রাসাদে। এখানে মা ও মেয়ে প্রায় আট বছর বন্দি থাকেন। নির্লজ্জভাবে পিতা মীরজাফর ও পুত্র মীরন উভয়েই লুৎফুন্নেসাকে বিয়ে করার জন্য জোরজবরদস্তি করতে থাকে। কিন্তু এই মহীয়সী নারী উভয়ের প্রস্তাব ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৭৬৫ সালে তিনি মুক্তি পেয়ে কন্যাসহ মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। এবং অতি দীন-হীন ভাবে জীবন কাটাতে থাকেন। ১৭৯০ সালের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি স্বামী নবাব সিরাজের কবরগাহে তসবিহ, তাহলিল, তেলাওয়াত, দোয়া, দরুদ পাঠ করেই কাটান। মুর্শিদাবাদের তৎকালীন অধিবাসীরা একজন বেগমের প্রতি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা অশ্রুসিক্ত নয়নে অবলোকন করে।
সিরাজের অনুগত, দেশপ্রেমিক সেনাপতি ও আমত্যদেরও একে একে হত্যা-নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়। ষড়যন্ত্রকারী রায়দুর্লভ বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন অকৃত্রিম সিরাজভক্ত মোহনলালকে। খাজা আবদুল হাদি খানকে মীরজাফর মেরে ফেলেন বিশ্বাসঘাতকতা করে। সিরাজ অনুগত ঢাকার ভূতপূর্ব নায়েব রায়বল্লভ সেনকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারা হয়। পাটনার নায়েব, আরেক সিরাজ-সুহৃদ, রামনারায়ণকেও খুবই নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়। মোটের ওপর, পলাশীর যুদ্ধের ২০ বছরের মধ্যে প্রায়-সকল সিরাজ অনুগত সেনাপতি, আমীর-ওমরাহকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করা হয়।
মৃত নবাব সিরাজের চরিত্রেও অব্যাহতভাবে লেপন করা হতে থাকে কালিমা। ইতিহাসের সাম্প্রতিক গবেষণা একের পর এক প্রমাণ হাজির করেছে যে, নবাব সিরাজের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের ওপর যেসব কলঙ্ক আরোপ করা হয়েছিল, তার বেশির ভাগই ছিল নিকৃষ্ট মিথ্যাচারে ভরপুর। সিরাজ ‘অন্ধকূপ’-এ ইংরেজদের হত্যা করেছিলেন বলে যে প্রচার চালানো হয়, পরে প্রমাণিত হয় যে, তা ছিল ডাহা মিথ্যা। এই তথ্যটিও মিথ্যা যে সিরাজ রানী ভবানির সুন্দরী-বিধবা কন্যা তারা সুন্দরীর প্রতি লোলুপ নজর দিয়েছিলেন। সিরাজের প্রতি রানী ভবানির বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই অপবাদ রটানো হয়েছিল। এমন মিথ্যাচারও করা হয়েছিল যে, সিরাজ অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেট চিরে দেখতেন। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা প্রমাণ করেন যে, সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করার পূর্বে অজনপ্রিয় এবং নিন্দিত করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা এসব মিথ্যা প্রচার করেছিল।
লৌকিক বা লোকমুখে প্রচারিত মিথ্যাচারের পাশাপাশি বইপত্রেও সিরাজ বিদ্বেষ ও মিথ্যা অপবাদ প্রচার করা হয়। ১৭৫৭ সালের জুন মাসে ষড়যন্ত্রমূলক পলাশীর যুদ্ধ, সিরাজদ্দৌলাহর পতন, বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়া এবং ইংরেজ উপনিবেশিক অপশক্তি কর্তৃক বাংলা দীর্ঘমেয়াদে আক্রান্ত ও পরাধীন হওয়া সর্ম্পকে প্রধানত তিনটি আদি গ্রন্থের সূত্রে ইতিহাস চর্চিত হয়। এগুলোকে ভিত্তি করেই পলাশী ও তৎকালীন ইতিহাস আবর্তিত। কিন্তু গ্রন্থত্রয় প্রচণ্ডভাবে সিরাজ-বিদ্বেষ পোষণ করে তৎকালীন চিত্র জানিয়েছে বলে পরবর্তী গবেষকদের কাছে ধরা পড়েছে। ফলে ইতিহাসের বিকৃতি ও পক্ষপাত গোড়া থেকেই পলাশীর পুরো পরিস্থিতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এ কারণে, মূল ঐতিহাসিক সত্যের কাছে পৌঁছার পূর্বে গ্রন্থ তিনটি সম্পর্কে আলোকপাত করা সঙ্গত হবে। এবং কোন কোন দিক থেকে ভুল ও মিথ্যা তথ্য ঐতিতহাসিকভাবে চালিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোও চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
গ্রন্থত্রয়ের মধ্যে সবচেয়ে নবীন হলো, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখিত নাটক সিরাজউদ্দৌলা’ যা ইতিহাসের নয়, মূলত সাহিত্যের অংশ। ইতিহাসের বিষয় না হয়েও জনপ্রিয়তার কারণে এই নাটকটির মাধ্যমেই সিরাজ ও পলাশীর আখ্যান-কাহিনি মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, সাহিত্যের সত্য বা বাস্তবতা আর ইতিহাসের সত্য বা বাস্তবতা একই বিষয় নয়। ফলে বিখ্যাত সাহিত্যিকদের অনেকেই উপন্যাস বা নাটকে বহু ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বিষয় চর্চা করেছেন, যেগুলো ঐতিহাসিক সত্য নয়; সাহিত্যের সত্য। লেখকের কল্পনার প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই পাঠক ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। ইতিহাসের সত্যের চেয়ে সাহিত্যের সত্যকেই মানুষ অধিকতর আপন করে নিয়েছে। এতে সাহিত্যিকের দক্ষতার প্রমাণ মিললেও ইতিহাসের বিকৃতি সাধনের দায়িত্বও কোনো কোনো লেখকের ওপর বর্তেছে। জনপ্রিয়তা ও পাঠকপ্রিয়তার জন্য অনেক লেখকই গোচরে বা অগোচরে এমন কাজ করেছেন বলে সাহিত্যের ইতিহাসে অনেকগুলো নজির রয়েছে।
অক্ষয় বাবুর নাটকটি ইংরেজ আমলে লিখিত এবং ইতিহাস হিসাবে গবেষণাপ্রসূত বিবরণ নয়। ফলে এতে লেখকের নিজস্ব বিলাস, কল্পনা, বিশ্লেষণ বহুলাংশেই ঐতিহাসিক সত্যের পরোয়া না করেই লিখিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, শহরে-গ্রামে এ নাটক বহুলভাবে প্রদর্শিত হয়েছে এবং ঐতিহাসিক সত্যের উপরে আসন লাভ করেছে।
অন্য দুটি গ্রন্থের রচয়িতা প্রায় সমসাময়িক এবং সেগুলো লিখিতও হয়েছে ঘটনার পর পরই। একটির নাম “রিয়াজ-উস-সালাতিন”, লেখক গোলাম হুসেন সলীম। অপরটি “সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন”, লেখক সাইয়েদ গোলাম হোসেন। রিয়াজ-রচয়িতা গোলাম হুসেন বয়সের দিক থেকে মুতাখখিরিন-রচয়িতা গোলাম হোসেন অপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠ হলেও উভয়েই প্রায় এক সময়েই আপনাপন ইতিহাস সমাপ্ত করেন। রিয়াজ-রচয়িতা গোলাম হুসেন দরিদ্র গৃহস্থ। মুতাখখিরিন-রচয়িতা গোলাম হোসেন নবাব আলীবর্দীর আত্মীয় এবং সম্ভ্রান্ত ওমরাহের মধ্যে পরিগণিত।
আত্ম পরিচয় দানকালে রিয়াজ-রচয়িতা স্বয়ং লিখেন: “আমরা দীনদাস, মোহাম্মদের মধ্যস্থতার প্রার্থী, নাম গোলাম হুসেন, উপাধি সলীম ফকির, জৈদপুর, আমরা উচ্চপদাভিষিক্ত সম্মানভাজন সচ্চরিত্র, দয়ালু, ধীর স্বভাব, মহত্ত্ব ও ব্যবহারে প্রশংসনীয়, হাতেমের ন্যায় দানশীল, নওশেরওঁয়ার ন্যায় সদ্বিচারক এবং লোকপ্রিয়তা ও প্রশংসা সম্বন্ধে উদাসীন মিস্টার জর্জ উডনি মহোদয়ের নিকট কিছুকাল যাবৎ কর্মে নিযুক্ত হয়েছি। ”
এসব অতিশয়োক্তির জন্য তাকে চাটুকার বলে অনেকেই অবজ্ঞা করেন। মিস্টার জর্জ উডনি কেবল অন্নবস্ত্রদানের জন্যই হুসেনের নিকট হতে এতদূর প্রশংসা লাভ করেননি। সিরাজউদ্দৌলা নাটকের রচয়িতা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় জানাচ্ছেন যে, “উডনির ইতিহাসনুরাগ প্রবল ছিল, এবং তাহার উত্তেজনাক্রমেই রিয়াজ-উস-সালাতিন রচিত হইয়াছিল। ”
পলাশী যুদ্ধের ২৭ বছর পর উডনি সাহের ১৭৮৪ সালে নীলকুঠি অধ্যক্ষ হয়ে মুর্শিদাবাদ সংলগ্ন মালদহ আগমন করেন। তখন তার বয়স ২৪ এবং ক্ষমতা ও তেজ বিপুল। গোলাম হুসেন জানাচ্ছেন: “সহৃদয় মিস্টার জর্জ উডনি পুরাতত্ত্ব ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত বিষয়ক গ্রন্থ সর্বদা পাঠ করতেন এবং সর্বপ্রকার জ্ঞান ও শিক্ষালাভে উৎসাহী ছিলেন। হিজরি ১২০০ সালে (ইংরেজি ১৭৮৬) তিনি বঙ্গদেশের স্বাধীন নরপতি ও শাসক কর্তৃপক্ষের জীবন বৃত্তান্ত ও কার্যক্রম জানার জন্য উৎসুক হন। এজন্য তিনি প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ হতে তথ্য সংকলন করে জনসাধারণের বোধগম্য পারস্য ভাষায় বিবৃত করতে আদেশ দেন। আমরা বিদ্যাবুদ্ধিহীন, তথাপি প্রভুর নিয়োগ পালন করা কর্তব্য বলে এমন দুঃসাধ্য কার্য সম্পন্ন করতে স্বীকার করি। আমরা গ্রন্থ সংকলনে প্রবৃত্ত হয়ে নানা স্থান হতে বহু গ্রন্থ সংগ্রহ করে দুই বৎসরকাল এ কাজে ব্যাপৃত ছিলাম। হিজরি ১২০২ মোতাবেক ইংরেজি ১৭৮৮ (পলাশীর ৩১ বছর পর) সালে গ্রন্থ সমাপ্ত করে উহা রিয়াজ-উস-সালাতিন নামে অভিহিত করি। ”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গোলাম হুসেন অযোধ্যা লোক এবং নিজেকে কখনো বাঙালি মনে করতেন না। রিয়াজ উস সালাতিনে দেখতে পাওয়া যায়, গোলাম হুসেন মিস্টার জর্জ উডনি মহোদয়ের নিকট কালক্রমে কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এর মাত্র দুই বছরের মধ্যেই কোন পূর্ব-প্রস্তুতি, পূর্ব-অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে বহিরাগত ভিন্ন অঞ্চল-সমাজ-ভাষার লোক হয়েও পলাশী কেন্দ্রিক একটি জটিল ইতিহাস গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করা অস্বাভাবিক বিষয়।
এরূপ বহু অস্বাভাবিক বিষয়ই বাংলার ইতিহাস, বিশেষত পলাশী ও সিরাজদ্দৌলাকে আবর্তিত করে লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা মূলত সিরাজ-পরবর্তী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সিরাজকে কালিমালিপ্ত করার ইতিহাস বিকৃতি মাত্র। এহেন গ্রন্থ হতেই পরবর্তী ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ড সাহেব ইতিহাস সংকলন প্রণালীর আভাস প্রাপ্ত হন। ঐতিহাসিক বেভারিজ এবং ব্লকম্যান রিয়াজ উস সালাতিনের যথাযোগ্য প্রশংসা করতে ত্রুটি করেননি। রিয়াজের ভূমিকাংশ থেকে তাদের প্রশংসা বাণী উদ্ধৃত করা হলে তা অনুধাবন করা সম্ভব হবে:
মিস্টার বেভারিজ লিখেন: The publication by our society of the Riyaz-us-Salatin is a valuable contribution to the history of Bengal. ব্লকম্যান তার Geography and History of Bengal গ্রন্থে লিখেন: The latest writer of Bengal History is Ghulam Hussain of Zaidpur poetically styled Salim, who compsoed his Riyaz us Salatin, the Garden of Kings at the request of Mr. George Udny of Maldha. This work, the title of which contains in the numerical value of the letter the date of its completion (A.B. 1202 or A.D 1787-88) is rare, but is much prized as being the fullest account in Perisian of the Mohamedan History of Bengal, which the author brings down to his own time.
অতএব, বাংলার ক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃতির সূচনা ১৭৫৭ সালের পলাশীর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র মতো লেখকও অন্যভাবে যে সত্যটি স্বীকার করে বলেছেন, “বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। যাহা কিছু বাঙ্গালার ইতিহাস নামে পরিচিত, তাহার অধিকাংশই বাঙ্গালীর লেখনী প্রসূত নহে। যাহাবা বাঙ্গালীর লেখনী প্রসূত তাহাও বিদেশীয় লেখকবর্গের চর্ব্বিতচর্ব্বণ মাত্র। ”
কবি নবীনচন্দ্র সেন ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যে ইংরেজের জয়গান এতই কুরুচিপূর্ণভাবে গেয়েছেন যে, প্রসঙ্গটির উল্লেখপূর্বক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বলেন: “সেকালে ইংরেজ ও বাঙ্গালী মিলিত হইয়া সিরাজের নামে কত অলীক কলংক রটনা করিয়া গিয়াছেন তাহা ইতিহাসের নিকট অপরিচিত নহে। অবসর পাইলে একালের প্রতিভাশালী সাহিত্যসেবকরা এখনো কত নূতন নূতন রচনা কৌশলের পরিচয় প্রদান করিতে পারেন, পলাশীর যুদ্ধ উহার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যাহা সেকালের লোকেও জানিত না, যাহা সিরাজউদ্দৌলার শত্রুদলও কল্পনা করিতে সাহস পাইত না, এ কালের লোকে তাহারও অভাব পূরণ করিতে ইতস্তত করিতেছে না। ”
পরবর্তী পর্ব
দুর্ভাগা সিরাজের ভাগ্যলিপি
পূর্ববর্তী পর্ব
অতঃপর যুদ্ধের নামে তামাশা
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৭
জেডএম