সকল দেশের প্রায়-সকল পণ্ডিতই মনে করতেন যে, পৃথিবী ও আকাশের গতিবিধি তথা শৃঙ্খলার মর্ম বুঝতে পারলে, পৃথিবীর মর্মকথাও ধরতে পারা যাবে। জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যাবিলনের অবদান যদি হয় পর্যবেক্ষণে, গ্রিকদের গৌরব হল সেসব তথ্যের যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণে।
আদিতে পৃথিবী এবং এরই সূত্রে মানচিত্র নিয়ে গ্রিকদের চিন্তায় এইসব ধারণা সূচিত হয় মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। সে সময়ে গ্রিসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী শহর বা নগরকেন্দ্র ছিল, এথেন্স বা স্পার্টা নয়, মিলেটাস নামের একটি ক্ষুদ্র নগর। এশিয়া মাইনরের একটি অতি ব্যস্ত প্রাচীন-বন্দর মিলেটাস। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই পাঁচমিশালী-বারোয়ারী মানুষের ভিড়।
বর্তমানে অবশ্য বন্দরটির ভৌগোলিক অবস্থান তুরস্কের আনাতোলিয়ার উপকূলে। তবে প্রাচীনকালে বিশাল গ্রিক সাম্রাজ্যের ওই অন্যতম নগরকেন্দ্রটিতে প্রাধান্য ছিল আইওনিয়ান গ্রিকদের। এরা ছিল বন্দরের শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার। মজার ব্যাপার হল, আইওনিয়ানরা ছিল যথেষ্ট যুক্তিবাদী। প্রাচীন ও ট্র্যাডিশনাল গ্রিকদের উপকথার দেবলোক বা মিথের কল্পজগৎ থেকে মুক্ত এবং স্বাধীন চিন্তার কৌতুহলী অর্থনৈতিক শ্রেণী বা সওদাগর ছিলেন আইওনিয়ানরা। নতুন নতুন শিল্প-বাণিজ্যের বাস্তব ভূবন তাদেরকে উপকথার দেব-দেবীভিত্তিক মোহের জগৎ থেকে মুক্ত রাখে।
দেব-দেবী পূজারি গ্রিকদের দেশেই এহেন যুক্তিবাদী পরিবেশ-পরিস্থিতিতে আইওনিয়ান সম্প্রদায়ের মধ্যে আবির্ভাব থ্যালেস নামে একজনের। তাকে বলা হয় আইওনিয়ান-গ্রিক শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের একজন। তার ছিল জলপাই তেলের কারখানা। তাতে তিনি রীতিমতো বিত্তশালী হন। আশ্চর্যজনকভাবে ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিদ্যারও আরাধনা সমান মনোযোগে চালিয়ে যান। প্রাচীন সব জ্ঞান, যেমন, মিশরের জ্যামিতি, ব্যাবিলনের জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদির চর্চা করতে করতে তার পাণ্ডিত্য এমনই প্রখর হয়ে ওঠে যে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮ অব্দে তিনি হিসাব কষে সূর্যগ্রহণের আগাম তারিখ ঘোষণা করতে সমর্থ হন।
পণ্ডিত থ্যালেস পৃথিবী নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছিলেন। প্রাথমিক সেসব ভাবনা আজকের বিবেচনায় অবশ্য ক্রটিপূর্ণ। উপকথায় আস্থাবান না হয়েও তিনি ‘সমান’ পৃথিবীতত্ত্বে আস্থা রেখেছিলেন। প্রকৃতির মধ্যে শৃঙ্খলা খুঁজতে গিয়ে তিনি এক সময় ঘোষণা করলেন, সব কিছুরই আদি উৎস সমুদ্রজল। বৃষ্টিতে প্রকৃতির ঔজ্জ্বল্য, নীল নদের বন্যা, বন্যায় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, এসব পর্যবেক্ষণ করেই তিনি ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন।
তবে পৃথিবী গোলাকার, আদিতে এই তত্ত্ব যিনি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি বিখ্যাত গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস বা পাইথাগোরাস। তিনি জন্মেছিলেন মিলেটাস-এর পরবর্তীতে আরেক বিখ্যাত নগরকেন্দ্র সামস নামক একটি দ্বীপে। যৌবনে তিনি ইতালিতে চলে যান। সেখানে ক্রোটনা শহরে দর্শন চর্চার জন্য একটি একাডেমি খোলেন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক শেষ হওয়ার আগেই তিনি ঘোষণা করেন, পৃথিবী সমতল নয়, সিলিন্ডার বা চোঙের মতো নয়, আয়তক্ষেত্র নয়, পৃথিবী আসলে ‘স্প্যারিক্যাল’ বা গোলাকৃতি। তিনি ও তার শিষ্যরা আরো বললেন, চাঁদ, সূর্য ইত্যাদিও গোলাকার, নিটোল গোল, পৃথিবীও তা-ই। এমনই ধারণা করতেন আরও দুইজন গ্রিক দেশীয় নমস্য পণ্ডিত, প্লেটো আর এরিস্টটল।
এরিস্টটল বলেছিলেন, আমাদের অনুভূতিই প্রমাণ করছে পৃথিবী গোলাকার। আকাশ, সমুদ্র, সমুদ্রে জাহাজের আসা-যাওয়া, ছোটদের ভূগোল বইতে বর্তমানে গোলাকার পৃথিবীর সমর্থনে যেসব প্রমাণ পেশ করা হয়, বলতে গেলে এরিস্টটলও তেমনভাবেই বলেছিলেন। তবে তিনি নাকি এমনও বলেছিলেন যে, ওই গোলক অতি বৃহৎ নয়!
গ্রিকরা এসব যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু মেনেই বসে ছিলেন না। তাদের ভাবনা আরও প্রসারিত হয়েছিল। তারা ভাবলেন, না হয় বুঝলাম পৃথিবী ‘স্পেয়ার’ বা গোলাকার, কিন্তু পৃথিবী নামক গ্রহটি কত বড় গোলাকার? কী এর পরিধি? তৎকালের বিশ্ব-জগৎ সম্পর্কে ধারণাকে সামনে রেখে এরিস্টটল হিসাব-নিকাশ করে বললেন, পৃথিবীর পরিধি বা ঘের ৬৪ হাজার কিলোমিটার। আরেক প্রাজ্ঞ আর্কিমিডিস তার হিসাবে জানালেন, পৃথিবীর পরিধি ৪৮ হাজার কিলোমিটার।
গ্রিকরা যে পৃথিবীর পরিধি নিয়ে ভেবেছে, তার প্রমাণ এরিস্টটল ও আর্কিমিডিসের হিসাব। কারটা ঠিক, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, তারা পৃথিবীকে মেপে নির্ধারণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তারা মানব-চিন্তার জগতে এ বিষয়টি সংযোজন করলেন যে, পৃথিবী নামক অধরা আবাসস্থলটিও পরিমাপযোগ্য।
পূর্ববর্তী পর্ব
মানচিত্র নিয়ে পাগলামি-খেয়ালি চিন্তা
পরবর্তী পর্ব
মানচিত্র চর্চায় একজন ‘পেনথালস’
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৭
এমপি/জেডএম