পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র রচনার গৌরব যাদের, সেই চীনারা কি পৃথিবী পরিমাপের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে গেছে? এ বিষয়টিকে এড়িয়ে তো মানচিত্র রচনায় এগুনো যায় না? চীনারা বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে, তবে গ্রিকদের মতো নয়, অন্যভাবে ও অন্য আঙিকে।
কারণ প্রাচীন চিনারা অবশ্য পৃথিবীকে সমুদ্রঘেরা একটি বর্গক্ষেত্র বলেই বিশ্বাস করত।
মাপটা আদৌ সঠিক নয়। তবে মনে রাখতে হবে যে, চার হাজার বছর আগে তারা এরকম একটি প্রশ্ন নিয়ে ভেবেছিলেন। উত্তরের সন্ধানে কাজ করেছিলেন। একটি ধারণাও দিয়েছিলেন। সেটা কম কথা নয়।
পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানসম্মত আয়তন যিনি স্থির করেন, তিনি কোনো গণিতবিদ নন। মজার বিষয় হলো, তিনি একজন গ্রন্থাগারিক বা লাইব্রেরিয়ান। তার নাম এরাটোসথেনিস। তার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ২৭৬ অব্দ থেকে ১৯৬ অব্দ। সেসময়, নীল নদের বদ্বীপে ভূমধ্যসাগরের তীরে আলেকজান্ডার প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানদীপ্ত শহর আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি বসবাস করতেন। ৩২৩ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যু কালেও সেটা শুধু গ্রিক-জগতেই নয়, তৎকালীন তাবৎ বিশ্বের উজ্জ্বলতম শহর ছিল। সেখানে নানা এলাকার গ্রিকরা তো বটেই, আরও সমবেত হত মিশরীয়, ইহুদি, পারসিক, সিরিয়ান, নিগ্রোসহ নানা জাতের মানুষ।
একজন অনামা প্রাচীন গ্রিক কবি লিখেছেন, আলেকজান্দ্রিয়া প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির শহর। এখানে ধন-দৌলত, ক্রীড়াভূমি, দর্শনীয় নানা বস্তু, বিবিধ মূল্যবান পশরা, রাজকীয় প্রাসাদ-কী নেই। রয়েছে বিজ্ঞান-চর্চার কেন্দ্র, গ্রন্থাগার, উৎকৃষ্ট মদ্য, সুদর্শন তরুণ, শান্ত নীল আকাশ এবং সুন্দরী রমণীরা।
তবে দুনিয়ার বিদ্বজ্জনের কাছে আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান আকর্ষণ ছিল বিস্ময়কর মিউজিয়াম বা জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার। আলেকজান্দ্রিয়া তথা মিশরের অধিপতি তখন গ্রিকরা। আলেকজান্ডারের পরে সেখানে যে রাজবংশ নিজেদের শাসন কায়েম করেছিল, তাদের বলা হত টলেমি বংশ। এরা মোটা হারে কর আদায়ের জন্য কুখ্যাত হলেও এদের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী এবং বিদ্যোৎসাহিতার স্বভাব ছিল। এদের জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক আভিজাত্য ছিল তুলনাহীন। তারা কলাদেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে নাট্য-কাব্য-শিল্পে মশগুল থাকতে পছন্দ করত।
টলেমিরাই জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার গড়ে আলেকজান্দ্রিয়াকে পরিণত করে সে-কালের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিদ্যা ও জ্ঞান কেন্দ্রে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের জ্যোতির্বিদ, গাণিতিক, চিকিৎসক, গবেষক, ঐতিহাসিক, লেখক, কলাবিদ, দার্শনিক জড়ো হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ায়। দিমেস্টিউস, স্ট্রাবো, ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, অ্যাপোলোনিয়াস, ক্যালিম্যাকিউস প্রমুখ দিগ্গজ ভাবুক-চিন্তকেরা তৎকালে সমবেত হয়েছিলেন সেখানে।
উল্লেখ করার বিষয় হলো, সকল পণ্ডিতই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভাতা পেতেন। সকলের জন্যেই ছিল খাওয়া-পরার সুবন্দোবস্ত। খ্রিস্টপূর্ব ২৪০ অব্দে তৃতীয় টলেমির আমলে এরাটোসথেনিস, যিনি পৃথিবী পরিমাপের জন্য খ্যাত, আলেকজান্দ্রিয়ায় এসে যোগ দিলেন সেই বিখ্যাতদের দলে। তিনি ছিলেন মিশরের পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ। এথেন্স-এ দর্শন, বিজ্ঞান ও গণিতচর্চা করেছেন। কবিতাও লিখতেন। অন্যান্য বিষয়েও বই ছিল তার। একসঙ্গে একাধিক বিষয় চর্চার জন্য তাকে বলা হত-‘পেনথালস’ বা ‘সব্যসাচী’।
ক্রীড়াঙ্গনের পাঁচটি বিভাগে যারা দক্ষতা দেখায়, গ্রিকরা তাদেরকেই বলে ‘পেনথালস’। গ্রিকদের বিবেচনায় বহিরাগত মানুষটি ‘বিটা’ বা দ্বিতীয় বলে গণ্য হতে পারেন, ‘আলফা’ বা প্রথম নয়। এহেন দ্বিতীয় শ্রেণীর গ্রন্থাগারিকই হিসাব কষে দেখিয়ে দিলেন, পৃথিবীর পরিধি। ততদিনে মানুষ পৃথিবীর ৩৬৫ দিনে সূর্য পরিক্রমার কথা জেনে গেছে।
আকাশকে অনুসরণ করে মাটিতে মনের মানচিত্রে আঁকা হয়ে গেছে বিষুবরেখা এবং কর্কট ও মকরক্রান্তি। এমন কি, আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনের জ্যোতির্বিদরা বৃত্তকে ৩৬০ ভাগে ভাগ করার কাজটিও করে ফেলেন। ফলে মানব জ্ঞান বিকশিত হতে থাকে নানা জাতির হাত ধরে।
পূর্ববর্তী পর্ব
গোলাকার-অধরা পৃথিবীও পরিমাপযোগ্য
পরবর্তী পর্ব
টলেমির মানচিত্র
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৭
এমপি/জেডএম