চুম্বক আবিষ্কৃত হয়ে গেল ততদিনে। কে তা আবিষ্কার করেছিলেন, মানচিত্র রচনায় কিংবা সমুদ্রযাত্রায় কারা সে বস্তুটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন, সে তথ্যটি কেউ আজ আর জানে না! অনুমান করা হয় এগারো শতকে দিগদর্শনের জন্য চীনারা প্রথম চুম্বকের ব্যবহার করে।
চুম্বকের পর এলো কম্পাস। এটির ব্যবহার শুরু হয় ১৩০০ সালে বা তারও আগে। যদিও জ্যোতির্বিদরা তৎকালেই বৃত্তকে ভাগ করতে জানতেন, তবু প্রথম দিকের কম্পাসে ডিগ্রি নয়, বায়ু ছিল নির্দেশক। ৩৬০ ডিগ্রির চেয়েও সমুদ্রগামী নাবিকের কাছে জরুরি ছিল বারোটি বায়ুর স্রোত। কম্পাসে রয়েছে তারই নিশানা। ক্রমে ক্রমে আরও ভাগ করে নির্দেশিত হয় আটটি প্রধান বায়ুস্রোত, আটটি অর্ধ-বায়ু, ষোলটি বিষুব-বায়ু, সব মিলিয়ে বত্রিশটি পাপড়ির একটি অখণ্ড ফুল। প্রাচীন ভাষায় যাকে বলা হত, ‘রোজা ডস ভেনটস’ বা ‘বাতাসি গোলাপ’।
এখানেই শেষ নয়, আরও অনেক মজার কাণ্ড ঘটে মানচিত্রের ইতিহাসে। চতুর্দশ শতকের সূচনায় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী নানা বন্দরে গড়ে ওঠে সমুদ্রপথের ‘চার্ট’ বা পথরেখা তৈরির কেন্দ্র। যেগুলো অবস্থিত ছিল পিসা, জেনোয়া, ভেনিসের মতো নামজাদা বিভিন্ন বন্দরে। এগুলোকে বলা হত ‘পোর্টোলান চার্ট’। ওই সব কেন্দ্রে নৈপুণ্যের সঙ্গে তৈরি হত অনেক রকমের চার্ট, যা শুধু ভূমধ্যসাগরের তটরেখার যথাযথ বিবরণ নয়, কৃষ্ণ সাগর, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রতট পর্যন্ত নির্ভুলভাবে চিহ্নিত।
বোঝা যায়, নাবিকদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই রচিত হচ্ছিল এইসব চার্ট। কোনো কোনোটি ছিল আরও উচ্চাভিলাষী। সেখানে স্থান পেত আফ্রিকার উপকূল এবং ভারতের পশ্চিম তটরেখার বিবরণও। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩৭৫ সালে ফ্রান্সের পঞ্চম চার্লস-এর উদ্যোগে ছয়টি মানচিত্র নিয়ে তৈরি হয় একটি ‘অ্যাটলাস’। তাতে ভারতের মালভূমি মোটামুটিভাবে অবয়ব লাভ করেছে, চিনের কিছু নদী ও নগর ঠাঁই পেয়েছে, নীল নদের প্রবাহও ধরা পড়েছে। মানচিত্র আঁকিয়ে কোথাও কোথাও তট ছেড়ে উঁকি দিয়েছেন দেশের ভেতরেও।
বলা হয়, এই রঙিন মানচিত্রটি থেকে বোঝা যায় হাজার বছর পরে আবার মানুষের হাতে এসেছে মানচিত্র রচনার বিদ্যা। বৈজ্ঞানিক কৌশল এবং একে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার মতো যুক্তিবুদ্ধিও। এভাবে মধ্যযুগ পেরিয়ে ইউরোপে নতুন ভোরের আভাস পরিলক্ষিত হয়।
ইউরোপের এই নবজাগরণে আরব মুসলমানদের রয়েছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। লুপ্ত গ্রিক মনস্বীদের জ্ঞানের ভাণ্ডার অতি যত্নসহকারে এতকাল আগলে রেখেছিলেন আরব-মুসলমানেরাই। গ্রিক দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং নানা বিষয়ে শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান ভাণ্ডাার গড়ে তুলেছিলেন আরবরা। ইউরোপে যখন অন্ধকার মধ্যযুগ, আরবে তখন জাগরণের আলোকিত স্বর্ণালী অধ্যায়। জ্ঞান চর্চা, অনুবাদ, রাজনৈতিক উৎকর্ষতা ইত্যাদিতে মুসলমানরা তখন আরব ভূমি থেকে এশিয়া-আফ্রিকা, এমনকী ইউরোপ পর্যন্ত নিজেদের ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান-চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইউরোপ নিজেদের হারানো জ্ঞানগত আর অতীত-ঐতিহ্যকে খুঁজে পেয়েছিল মুসলমানদের মধ্যে। দামেস্ক, বোগদাদ, কর্ডোভা, সমরখন্দ, বোখারার পাঠাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আলোয় কেটেছিল ইউরোপের অন্ধকার।
উদাহরণ স্বরূপ, বিখ্যাত ক্লডিয়াস টলেমির কথাই ধরা যাক। হারিয়ে যাওয়া টলেমির ভূগোল ছিল আরবদের ঘরে, মূল ভাষ্যে ও অনুবাদে। আরবরা সেটা চর্চা করে ভূগোলের ধারণা ও জ্ঞানকে আরও এগিয়ে নেন। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে রক্ষা করেন টলেমির কৃতিত্ব। তা না হলে তার কথা কেউ জানতেই পারতো না।
ততদিনে ইউরোপের ছাপার যন্ত্র বা প্রেস এসে গেছে। গুটেনবার্গের আবির্ভাব হলো। সহজে অদল-বদল করা যায় এমন ধাতব হরফ নিয়ে এল মুদ্রণযন্ত্র। ছাপা হল টলেমির মানচিত্র। গোটা বিশ্ব উত্তেজিত। ইউরোপ উদ্বেলিত তাদের নিজেদের অর্জনের কথা জানতে পেরে। উত্তেজনা-উদ্বেলের জ্ঞানগত টানটান পরিবেশের আগুনকে আরও উস্কে দিল মার্কো পোলোর ভ্রমণবৃত্তান্ত। জানা গেল অজানা বিশ্বের কথা। ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে বিশ্ব-সংসারের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে মার্কো পোলো চব্বিশ বছর চীনে বসবাসের বিবরণ প্রকাশ করলেন। পশ্চিমের ভূগোল ধারণাকে তার মতো বাস্তবভিত্তিতে এতটা সমৃদ্ধ আর কেউ করতে পারে নি।
মার্কো পোলোর পথরেখা বা ভ্রমণপথ প্রথম ঠাঁই পায় ১৪৫৯ সালের একটি মানচিত্রে। তারপর থেকে প্রতিটি মানচিত্রে তার উপস্থিতি। মানচিত্র মানেই হল পোলো’র গমন-নির্গমন পথের সচিত্র বর্ণনা। নবজাগ্রত ইউরোপ তৈরি হয়ে গেল দিকে দিকে জাহাজ ভাসাতে। শুরু হল ‘এজ অব ডিসকভারি’ বা ‘আবিষ্কারের যুগ’। ইউরোপ দ্রুত এগিয়ে চলে ঐতিহাসিক ১৪৯২ সালের দিকে।
পূর্ববর্তী পর্ব
টলেমির মানচিত্র
পরবর্তী পর্ব
ভাস্কো ডা গামা আর কলম্বাসের লড়াই
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭
এমপি/জেডএম