অ্যাটলান্টিকে অতল জলে ভেসে চলেন তিনি। দলে নাবিক ছিল ২৮০ জন।
ইউরোপের আলোকিত রেনেসাঁর যুগের সবচেয়ে খ্যাতিমান মানচিত্র রচয়িতা গেরারডুস মার্কেটার। জার্মান মা-বাবার ষষ্ঠ সন্তান তিনি। জন্মেছিলেন অ্যান্টুয়ার্পের রুপেলমন্ত নামের একটি ছোট্ট শহরে, ১৫১২ সালে। তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, বিখ্যাত খ্রিস্টিয় সংস্কারবাদী মার্টিন লুথার তখন উইটেনবার্গ গির্জার দরজায় ঐতিহাসিক ইস্তেহার সেঁটে দিয়ে খ্রিস্টিয় চিন্তার জগতে ঝড় তুলছেন এবং এভাবেই প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের সূচনা ঘটাচ্ছেন।
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের ফলে হলো রিফর্মেশন এবং কাউন্টার-রিফর্মেশন। তরুণ মার্কেটার যখন লোভান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যামিতি পড়ছেন, তখন ইউরোপের খ্রিস্টিয়-ধর্ম-জগৎ অস্থির-আলোড়িত। সম্ভবত মার্কেটারের মনেও সেদিন বির্তক আর সংশয় ছিল। অবস্থা এমন ছিল যে, এক বছর তিনি ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলেন পরিবেশের দোলাচলের কারণে। গির্জার নেতারা ভেবে বসলেন, এই তরুণ অবিশ্বাসী-ধর্মদ্রোহী। মার্কেটারকে কয়েদ করা হলো। ধর্মদ্রোহ বা ইনকুইজিশান অনেককেই প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে। কারো মাথা কাটা হয়, কাউকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়, কাউকে আগুনে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। ইউরোপের সেটি এক প্রচণ্ড বীভৎস চেহারা। কিছু প্রভাবশালী বন্ধুদের তৎপরতায় মার্কেটার কোনোক্রমে ভয়াবহ বিপদ থেকে বেঁচে গেলেন। সভ্যতার পথে সেটা অবশ্যই স্বস্তির কথা। কারণ পৃথিবীকে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল তার কাছে। উগ্র খ্রিস্ট মৌলবাদীদের হাতে তার প্রাণ গেলে সেটা হতো না।
ধর্ম ও গির্জার দিক থেকে নানা বিপত্তি পেরিয়ে মার্কেটারদের পরিবার অবশেষে চলে আসে ফ্ল্যান্ডার্স শহরে। পড়াশোনা শেষে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা মানে গ্লোব, সূর্যঘড়ি, মানচিত্র এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির ব্যবসা। চব্বিশ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি মানচিত্র ও চার্টের খোদাইয়ের কাজে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করেন। তার রচিত প্রথম মানচিত্রটি ছিল ছয় প্রস্থ কাগজে আঁকা প্যালেস্টাইনের মানচিত্র। ধর্মপ্রাণ ইউরোপে সেটি সংগ্রহ করার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। তিন বছর নিজে জরিপ করে অতঃপর তিনি প্রকাশ করেন ফ্ল্যান্ডার্সের মানচিত্র। ১৫৩৮ সালে তার রচিত বিশ্বের মানচিত্রে স্বতন্ত্রভাবে স্থান পায় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা। আরও অনেক কীর্তি রয়েছে তার। পৃথিবীকে তিনি দু’টি গোলকে ভাগ করেন, পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধ। এর মাঝামাঝি অংশে দেশ বা স্থান যথাযথ ছিল, স্কেলেও কোনো ক্রটি ছিল না। কিন্তু ধারের দিকে তাকালে যেন খানিকটা সঙ্কুচিত দেখা যায়, অঞ্চলগুলো বুঝি-বা ম্যাপ বা মানচিত্রের বাইরে পড়ে যায়। ফলে এই দুই গোলক কিছুটা বিকৃত বটে। কিন্তু এটা স্পষ্টরূপে বোঝা যায় যে, পৃথিবী গোলাকার। মার্কেটারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব পুরোপুরি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে মানচিত্রের উপস্থাপনা। সেদিন তিনি যা করেছিলেন, বলতে গেলে সেটা যুগান্তকারী, বৃত্তকে তিনি পরিণত করেছিলেন বর্গক্ষেত্রে। প্রথমবারের মতো তিনি সমগ্র পৃথিবীকে এক সমতলে সাজিয়ে সরলরেখায় বন্ধন করলেন। জিজ্ঞাসু, ভ্রমণকারী কিংবা নাবিক বা পরিব্রাজক, সকলেই অতঃপর সাদা চোখে, সহজ বিবেচনায় পৃথিবীর দিকে তাকাতে পারেন। নাবিক এক সরলরেখা থেকে অনায়াসে চলে যেতে পারে অন্য রেখায়।
আশ্চর্য এক ঘটনাই বটে। ওই মানচিত্র প্রকাশিত হয় ১৫৫৯ সালে। পনের বছর পরে ১৫৭৬ সালেও এর দাম মাত্র ১ পাউন্ড ৬ শিলিং ৬ পেন্স। এতো সুলভ আর এতো সহজ মানচিত্র আগে আর কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি। তারপরেও একশ’ বছর লেগেছিল মানচিত্রটি সবার কাছে গৃহীত হতে। এখন বিশ্বব্যাপী স্কুল পড়ুয়াদের ভূগোল বা ম্যাপের বইয়েও থাকে ‘মার্কেটারস প্রজেকশান’। তারপর কতো মানচিত্র-বিশারদ কতোভাবেই না উপস্থাপন করেছেন এই বিশ্ব-জগতকে!
পূর্ববর্তী পর্ব
ভাস্কোডা গামা আর কলম্বাসের লড়াই
পরবর্তী পর্ব
গ্রিক পুরানের ‘অ্যাটলাস’, কাঁধে পৃথিবীর বোঝা
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৭
এমপি/এইচএ/