বিংশ শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের অন্যতম একজন চে গেভারা। শৈশব থেকেই চে’র মধ্যে সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তৈরি হতে থাকে।
ছাত্রাবস্তাতেই চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এসময় ওইসব লাতিন আমেরিকার মানুষের দারিদ্র্যতা ও দুঃখ-দুর্দশা তার মনে গভীর দাগ কাটে। মূলত এখান থেকেই তার মানুষের মুক্তির কল্যাণে বিপ্লবী কাজের অনুপ্রেরণা। যে বিপ্লবী আদর্শ তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পালন করেছেন।
চে গেভারা ছিলেন একজন রক্তের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। কিন্তু যার রক্তে ছিল বিপ্লবের নেশা, তিনি যে সমাজের আর ১০ জনের মত নির্দিষ্ট ধরাবাধা ছকে জীবন কাটাবেন না এটাই স্বাভাবিক। তিনি ছিলেন একাধারে বিপ্লবী, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ এবং সমরবিদ।
চে ছিলেন একজন বিশিষ্ট ডায়েরি লেখক। তিনি গেরিলা যুদ্ধের উপর একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। তরুণ বয়সে চে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতি কথাটিও অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি রচনা।
বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে মিলে বিপ্লব সফল হলে তিনি কিউবার বিপ্লবী সরকারে একাধিক দায়িত্ব পালন করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা এবং ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট।
যার রক্তে মিশে আছে বিপ্লবের মন্ত্র তিনি কি আর মন্ত্রিত্বের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? তিনি মন্ত্রিত্ব ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে চিঠি লিখে আবারও বেড়িয়ে পড়লেন বিপ্লবের উদ্দেশ্যে। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, আমরা স্ত্রী-পুত্র কিউবায় থাকলো, আশা করি সমাজতান্ত্রিক কিউবার অন্য নাগরিকরা যেসব সুবিধা পাবেন, তারাও সেই একই সুবিধা পাবে। উল্লেখ্য এখানে তার স্ত্রী-পুত্রের জন্য ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কাছে কোনো অনুরোধ কিংবা সুপারিশ করেননি।
চে গেভারা বৃহত্তর বিপ্লবের উদ্দেশ্যে ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করেন। প্রথমে কঙ্গো কিনসহাসায় তার বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। এখানেই সিআইএ মদতপুষ্ট বলিভিয়ান আর্মির হাতে তিনি বন্দি ও নিহত হন।
বলিভিয়ান আর্মি চে গেভারাকে ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে ও ৯ অক্টোবর দুপুর ১টা ১০ মিনিটে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যদিও মৃত্যুর সময় ও ধরন নিয়ে নানা মতভেদ এবং রহস্য রয়েছে। বুলিভিয়ার লা হিগুয়েরা নামক স্থানে বন্দি এবং নিরস্ত্র চে গেভারাকে নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়।
বলিভিয়ান আর্মি যখন চে গেভারাকে গুলি করতে এসেছিল তখনো তিনি তার সেই বিখ্যাত উক্তি বলেছিলেন, ‘আমি জানি তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছো, গুলি করো কাপুরুষ, তবে জেনে রাখো তুমি শুধু একজন মানুষকেই হত্যা করতে পারবে তার বিপ্লবী চেতনাকে নয়’।
বর্তমান সারাবিশ্বেই বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে চে গেভারা স্থান পান অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদে। বিপ্লবী চে গেভারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখায়, সমাজের নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা যোগায়। এজন্যই হয়তো তার সেই বিখ্যাত উক্তি এখনো প্রাসঙ্গিক ‘যখনি তুমি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠো, তখনি তুমি আমার একজন সহ-যোদ্ধা’।
সুতরাং চে গেভারা যে বৈষম্যহীন সমাজের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজের জন্য সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই হবে এ মহান বিপ্লবীর প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা নিবেদন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২০
আরকেআর/আরআইএস/