প্রশ্ন ঘুরছে, কে এই রাম রহিম? যার কথিত অনুসারীরা পুরো নয়াদিল্লির মসনদে বসে থাকা নেতৃত্বের কপালেও ঘাম ঝরিয়েছে? নিজের ওয়েবসাইটে তার পরিচয়, ‘সাধু চিকিৎসক গুরমিত রাম রহিম সিং জি ইনসান’। চলচ্চিত্রাঙ্গনে তার পরিচয় ‘মেসেঞ্জার অব গড’ বা ঈশ্বরের দূত।
আরও পড়ুন
** হরিয়ানায় গুরুর সম্পত্তি থেকে হতাহতদের ক্ষতিপূরণের আদেশ
** ধর্ষণে দোষী গুরমিত রাম রহিম, ভারতজুড়ে সতর্কতা
** হরিয়ানায় গুরু-ভক্তদের তাণ্ডবে নিহত ৩১, সতর্কতায় দিল্লি
হিন্দু, মুসলিম, শিখ— সব ধর্মের চেতনা মিশিয়ে গড়ে ওঠা হরিয়ানাভিত্তিক ‘অলাভজনক’ সমাজকল্যাণ ও আধ্যাত্মিক সংগঠন ‘ডেরা সাচা সৌদা’র প্রধান এই ‘গুরু’র জন্ম ১৯৬৭ সালে রাজস্থানের গুরুসর মোদিয়া গ্রামের এক শিখ পরিবারে। চার সন্তানের জনক রাম রহিম ‘ডেরা সাচা সৌদা’য় তৎপর হন ১৯৯০ সাল থেকে। তার সংগঠনের সদরদফতর হরিয়ানার সিরসায়। দাবি করা হয়, উত্তর-পূর্ব ভারতে মূল প্রভাব থাকলেও রাম রহিমের বিশ্বজুড়ে ছয় কোটি ভক্ত আছে। যদিও তার বিরুদ্ধে শিখদের অভিযোগ, রাম রহিম তাদের ধর্মবিশ্বাসকে বিদ্রুপ করে চলেছেন।
কৌতূহল হলো, এতো ভক্ত কিভাবে জুড়েছে রাম রহিমের? ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য, নিজের আলাদা ধর্মীয় পদ্ধতি চালু করা এই ‘গুরু’ রক্তদানসহ স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি, দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী সহায়তা, স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশগ্রহণ, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন এবং দলিতসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে নিজেকে সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০১০ সালে তিনি একটি গণবিয়ের আয়োজন করে সেখানে হাজারোধিক অনুসারীকে যৌনকর্মীদের সঙ্গে মালাবদল করান।
এই জনসমর্থনের সুযোগে রাম রহিম ব্যবহার করতে থাকেন স্থানীয় এমনকি কেন্দ্রীয় রাজনীতিকদের। গুরুর ভক্তদের ‘ভোটব্যাংকের’ কথা ভেবে রাজনীতিকরাও তার চরণতলে ছুটে ছুটে গেছেন বারবার। কলকাতার একটি বাংলা সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিনের মাথায় ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানে নামলে তাতে সাড়া দেন রাম রহিম। জবাবে তাকে প্রকাশ্যে ‘প্রণাম’ করেন প্রধানমন্ত্রী। মোদির ভাবগতি বুঝে হরিয়ানা-পাঞ্জাব-রাজস্থানের রাজনীতিকরাও ছুটতে থাকেন রাম রহিমের দরবারে। তাদের ভক্তিতে গদগদ হয়ে রাম রহিম রাজনৈতিকভাবে বিজেপিকে সমর্থনের কথা বলেন। হাতেনাতে ফলও পায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনরা। ২০১৪ সালের অক্টোবরে হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনে জিতে প্রথমবারের মতো রাজ্যে সরকার গঠনের সুযোগ পেয়ে যায় বিজেপি।
ভক্তদের ‘ঋষি’ আর রাজনীতিকদের ‘ভোটগুরু’ লাখ কোটি রুপির মালিক রাম রহিম তবে এমন ‘গ্যাঁড়াকলে’ আটকালেন কেন? সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, অনুসারীদের মধ্যে দুই নারীকে রাম রহিম ১৯৯৯ সালে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে উড়োচিঠিতে আসা সেই অভিযোগ তদন্তে গিয়ে সিবিআই প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে নামে গভীর অনুসন্ধানে। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ২০০২ সালে রাম রহিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সিবিআই। এরপর সেই মামলার বিচার করতে হরিয়ানারই পঞ্চকুলায় বিশেষ আদালত স্থাপন করা হয়। ২০০৭ সালে শুরু হয় শুনানি। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ায় সিবিআই আদালত এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছালো যে, রাম রহিম তার দুই নারী অনুসারীকে ধর্ষণ করেছেন।
সংবাদমাধ্যম বলছে, ধর্ষণের এই মামলায় এবার ফেঁসে গেলেও রাম রহিমের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ এর আগেও উঠেছিল। সিবিআই তদন্তের সূত্র অনুযায়ী, সংস্থাটির ধর্ষণ মামলা দায়েরের পর রহস্যজনকভাবে খুন হন ‘ডেরা সাচা সৌদা’র ম্যানেজার রঞ্জিত সিং। আর সেই খুন এবং ‘ডেরা সাচা সৌদা’কে নিয়ে প্রতিবেদন লিখে খুন হন সাংবাদিক রাম চন্দর ছত্রপতি। ওই দু’টি খুনের মামলাও এখন চলছে এবং দু’টি মামলায়ই খুনের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে রাম রহিমের বিরুদ্ধে।
কথিত অনুসারীদের চোখ রাঙানির মধ্যে ভারতীয়দের আস্থার জায়গা সিবিআই’র বিশেষ আদালত এখন রাম রহিমকে তার প্রাপ্য শাস্তি দেবে কিনা সেদিকে যেমন নজর সচেতন মহলের, তেমনি নজর খুনের দু’টি মামলার অগ্রগতির দিকেও।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৭
এইচএ/