বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামস জগলুল হোসেন মোয়াজ্জেমকে ৮ বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
এর আগে দুপুরে ওসি মোয়াজ্জেমকে সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
ইংরেজিতে লেখা রায়ের শুরুতেই দুই পক্ষের বক্তব্য, সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং যুক্তি ও যুক্তিখণ্ডনের সারসংক্ষেপ পড়ে শুনান। মামলার বাদী হিসেবে ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন কীভাবে যথার্থ ব্যক্তি (লোকাস স্ট্যান্ডাই) তার ব্যাখ্যাও দেন বিচারক। সবশেষ আদালত এই মামলায় ওসি মোয়াজ্জেমের দায় ও দণ্ড ঘোষণা করেন।
রায়ে বিচারক বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি এ কথা স্বীকার করেছেন যে, তিনি নুসরাত ও তার দুই বান্ধবীর বক্তব্য (যৌন হয়রানি) মামলার প্রয়োজনে রেকর্ড করেছেন। তিনি বলেছেন, ওই সময় থানায় ওসির কক্ষে পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন, যেখানে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয়। ওই সময় কক্ষে কোনো নারী পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। ভিডিওতে দেখা যায়, অভিযুক্ত বারবার নুসরাতের মুখ থেকে তার হাত সরাতে বলছেন। এর মাধ্যমে যৌন হয়রানির অভিযোগ দিতে গিয়ে সে আরেকদফা ভিন্নরকম হয়রানির শিকার হয়েছে।
আরও পড়ুন>>ওসি মোয়াজ্জেমের ৮ বছর কারাদণ্ড
বিচারক বলেন, আসামি নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্য ভিডিও করার কারণ হিসেবে যৌন হয়রানির মামলা তদন্তে প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন।
‘ওসি বলেছেন, শুধু ডিআইজি মোহাম্মদ আবুল ফয়েজকে ও স্থানীয় সাংবাদিক আতিয়ার সজলকে হোয়াটসঅ্যাপ ও শেয়ার ইট ব্যবহার করে এটি দিয়েছেন বলে তিনি স্বীকার করেছেন। তিনি নিজে সেটি সামাজিক মাধ্যমে বা ইউটিউবে শেয়ার করেননি বলেও দাবি করেছেন। কিন্তু এই তার বক্তব্য ভিডিও করাকে বৈধতা দেয় না। ভিডিও করার শুরু থেকেই ওসির কাজ ছিল বেআইনি। এমনকি যদি সেটি স্বয়ং তার দ্বারা রিলিজ নাও হয়ে থাকে। ’
আদালতের বিচারক বলেন, একজন ১৮ বছর বয়সী ওঠতি তরুণী থানায় আইনগত প্রতিকারের জন্য এসেছিলেন। তাই বিষয়টি দায়িত্বশীলভাবে দেখা এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ছিল ওসি হিসেবে তার কর্তব্য। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
আসামিপক্ষ দাবি করেছে যে, এই মামলার অভিযোগকারীর মামলা করার কোনো এখতিয়ার (লোকাস স্ট্যান্ডাই) নাই। কিন্তু এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় পুরো জাতি হতবাক হয়েছে। বাদী সমাজের একজন ব্যক্তি হিসেবে পুরো সংক্ষুব্ধ সমাজের পক্ষেই এই মামলা দায়ের করে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এরপর বিচারক মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে রায়ের দণ্ডের অংশ (শেষাংশ) পাঠ করে শুনান। রায়ে তার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারায় আনীত অভিযোগের দুটিতে দোষী সাব্যস্ত করে মোট ৮ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত।
আইনের ২৬ ধারায় মোয়াজ্জেমকে পাঁচবছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং ২৯ ধারায় তিন বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। জরিমানার অনাদায়ে তাকে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।
এছাড়া আইনের ৩১ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মোয়াজ্জেমকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। সাজা ধারাবাহিকভাবে (একটির পর একটি) কার্যকর হবে বলেও আদেশ দেন আদালত। তাই ওসি মোয়াজ্জেমকে দুটি অপরাধের দায়ে আট বছরই কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
তবে রায়ের আগে তিনি যে হাজতবাস করেছেন তা এই শাস্তির মেয়াদ থেকে বাদ যাবে। এরপর আদালত তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করেন।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা। রায় ঘোষণার সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন- নিহত মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান ও মামা সৈয়দ সেলিম। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
নুসরাতের ভাই রাশেদুল হাসান বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করবেন বলে আমরা খুশি।
মামা সৈয়দ সেলিম বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম যথাসময়ে নুসরাতের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে তাকে হয়তো অকালে জীবন দিতে হতো না।
অপরদিকে সাজার রায়ে সংক্ষুব্ধ ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আহাম্মাদ। তিনি বলেন, আমরা এই রায়ে সংক্ষুব্ধ। এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।
আর মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, যেসব ওসি থানাকে জমিদারিতে পরিণত করেছেন তাদের জন্য এই রায় একটি বার্তা। এই রায় থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা যেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে জনগণকে যথাযথ আইনি সেবা দেন।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৯
কেআই/এমএ