খুলনা: আযম খান সরকারি কমার্স কলেজ। খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৫টি জেলার বাণিজ্য বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটি।
প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, ক্লাসরুম, ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা, পরিবহন সুবিধাসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত কলেজটি।
১৯৫৩ সালের ১৪ আগস্ট নৈশ বিভাগে এইচএসসি ক্লাস থেকে কলেজটি যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯৫৪ সাল থেকে দিবা ও নৈশ উভয় বিভাগ চালু হয়। সেই সঙ্গে স্নাতক পর্যায়ের কোর্স শুরু হয়। ১৯৬৩ সাল থেকে কমার্সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স পড়ানো শুরু হয়। ১৯৭২ সাল থেকে হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এমকম চালু হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে ৭ মে কলেজটি জাতীয়করণ হয়।
বর্তমানে কলেজটিতে হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিংসহ চারটি বিষয়ে অনার্স ও হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্সসহ বিকম ও এইচএসসি চালু আছে। সব মিলিয়ে কলেজটিতে প্রায় ৮ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।
কলেজটিতে ৪৬টি শিক্ষকের পদ থাকলেও বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৩৫ জন।
সময়ের ব্যবধানে কলেজটিতে বিভাগ ও শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি বিন্দুমাত্র কোনো সুযোগ সুবিধা। ফলে শিক্ষক, আবাসন, পরিবহন ও ক্লাসরুম সঙ্কটসহ অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত কলেজটি।
ক্ষোভের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা বাংলানিউজকে জানান, ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাস ২.৭৮ একর। যা খুলনার অন্যসব কলেজের চেয়ে খুবই কম।
এখানে কোনো পরিবহন ব্যবস্থা ও খেলার মাঠ নেই। নেই মেয়েদের জন্য কোনো ছাত্রী হল। একটি ছাত্রাবাস থাকলেও (মজিদ ছাত্রাবাস) আসন সংখ্যা মাত্র ১শ।
এ কলেজের ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, ‘কলেজে কোনো ছাত্রী হল না থাকায় তাকে ৬ বছর ম্যাসে থাকতে হয়েছে। যা তার গরীব বাবার জন্য অনেক কষ্টের ব্যাপার।
তিনি আরও বলেন, ম্যাসে মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক অভিভাবক তার মেয়েকে এ কলেজে ভর্তি করছেন না। ফলে বাণিজ্য বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা থেকে গ্রামের অনেক মেয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন।
মার্কেটিং এ অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্রী ফারজানা মৌ বাংলানিউজকে বলেন, ‘কলেজটি ৮ হাজার শিক্ষার্থী থাকলেও কোনো গাড়ি নেই। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ’ তিনি আর বলেন, প্রতিদিন তাকে ডুমুরিয়া থেকে সীমাহীন কষ্ট করে বাস টেম্পুতে কলেজে আসতে হয়।
ছাত্রাবাসে সিট না পাওয়ার বেদনা প্রকাশ করতে গিয়ে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র নূর হোসেন বাংলানিউজকে জানান, রূপসাতে সে লজিং থাকে। যেখানে প্রায়ই পুলিশি গণগ্রেফতার চলে। তাকে কোনো অপরাধ ছাড়ায় দুই দুই বার গ্রেফতার হতে হয়েছে।
একমাত্র মজিদ ছাত্রাবাসে সিট পাওয়া মার্কেটিং এর ৩য় বর্ষের ছাত্র সুজন বড়ুয়া বাংলানিউজকে জানান, হলে থাকতে হলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের প্রায় মিছিলে যেতে হয়। না গেলে তারা মারধর করে।
তিনি আরও জানান, প্রতিরাতে এখানে জুয়া ও মাদকের আসর বসে। যার কারণে তিনি বর্তমানে সিট ছেড়ে দিয়ে ভাড়ার ম্যাসে থাকছেন।
কলেজের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, কলেজটিতে ২০০৪ সালে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিং বিষয়ে অনার্স চালু হলেও বিভাগ দুটিতে শিক্ষকের কোনো পদ সৃষ্টি করা হয়নি। বারবার আবেদন করেও এ বিষয়ে কোনো সাড়া মেলেনি।
অন্য বিভাগ এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে বিভাগ দুটি পরিচালনা করা হয়।
এছাড়া ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্স চালুর প্রস্তাব ফাইলবন্দি থাকায় এ বিভাগ দুটির মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, মাস্টার্স চালুর প্রয়োজনীয় সবরকম প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বারবার তা পিছিয়ে যাচ্ছে।
ফলে অনার্সে ভালো ফলাফল করেও প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার শিক্ষার্থী।
এদিকে, বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করে আসলেও খুব একটা কাজে আসছে না। তাই নিজেদের শিক্ষাজীবন বাঁচাতে এবং আগামীর শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে নাগরিক, সামাজিক ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেছেন তারা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সুমন রায় বাংলানিউজকে জানান, এ বছর অনার্সে ফিন্যান্সে ৫৩ জন এবং মার্কেটিংয়ে ১৮ জন প্রথম শ্রেণি পেয়েছে। এতো ভালো ফলাফল দেশের অন্য কোনো কলেজে হয়নি।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, খুলনাঞ্চলের অনেক জেলায় মার্কেটিং ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে অনার্স কোর্স চালু আছে। প্রতি বছর এ দুটি বিভাগ থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অনার্স কোর্স শেষ করে। কিন্তু এ বিষয়ে এলাকার কোনো কলেজে মাস্টার্স কোর্স চালু নেই।
ফলে বিভাগ দুটি থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীসহ অন্যান্য শহরের কলেজগুলোতে ভর্তি হয়। কিন্তু উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বৃহৎ অংশ অর্থের অভাবে খুলনার বাইরে যেতে পারে না। ফলে অনেক কষ্ট করে অনার্স শেষ করতে পারলেও মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করতে পারে না।
খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী আযম খান কমার্স কলেজে মাস্টার্স থাকবে না এটা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
আগামী শিক্ষাবর্ষের আগেই যাতে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিং বিভাগে মাস্টার্স চালু হয় তার জন্য সব ধরণের সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
এ ব্যাপারে আযম খান সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল বাশার মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, ‘মাস্টার্স চালুর জন্য সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কাগজ জমা দেওয়া হয়েছে। কেনো এখনও মাস্টার্স চালু হচ্ছে না তা’ আমারও বোধগম্য হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, ফিন্যান্স ও মার্কেটিংয়ের শিক্ষার্থীরা অনার্সে খুব ভালো ফলাফল করছে। মেধাবীদের শিক্ষাজীবন এ ভাবে ঝরে যাবে এটি কোনো ভাবেই কাম্য নয়।
পাঠক আগামীকাল বৃহস্পতিবার যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের প্রতিবেদন দেখতে বাংলানিউজ ভিজিট করুন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর