যশোর: “আসিতেছে...। মনিহার প্রেক্ষাগৃহে; রিয়াজ-শাবনুর জুটির সাড়া জাগানো নিটোল প্রেমের নতুন বাংলা সিনেমা...।
চলচ্চিত্রের এ বেহাল দশার কারণে একে একে মুখ থুবড়ে পড়ছে সিনেমা হলগুলো। ‘হারাধনের ছেলেদের মতোই যশোর শহর থেকে হারিয়ে গেছে ৩টি স্বনামধন্য সিনেমা হল। টিকে থাকা বাকি দু’টির অবস্থাও নাজুক।
আর সবমিলিয়ে যশোর জেলার ২২টির মধ্যে ১৮টি প্রেক্ষাগৃহই এখন বন্ধ। চলচ্চিত্র শিল্পে ধসের কারণেই এ পরিস্থিতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। তাই এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ প্রয়োজন বলেও তারা জানিয়েছেন।
যশোরের ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলের একটি ‘মনিহার কমপ্লেক্স’। বৈচিত্র্যময় এবং আধুনিক নির্মাণশৈলীর কারণে এ প্রেক্ষাগৃহের সুনাম দেশ জুড়ে ।
এ সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, দেশের অন্যতম বৃহৎ মনিহার সিনেমা হল ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর চালু হয়। ৪ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এ সিনেমা হলের আসন সংখ্যা এক হাজার ৪শ’৩০টি।
৪র্থ তলার এ সিনেমা হলটি পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আছে র্যাম সিঁড়ি, ঝড়না, ঝাড়বাতি ইত্যাদি। এর স্থপতি ছিলেন কাজী মোহাম্মদ হানিফ।
শামীম আহমেদের মতে, বিগত প্রায় একদশক ধরে সিনেমা ব্যবসায় মন্দাভাব বিরাজ করছে। একদিকে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব; অন্যদিকে দেশে ভালো সিনেমা তৈরি না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি জানান, এখন আর মানুষ সিনেমা হলে এসে চলচ্চিত্র উপভোগ করতে চায় না। এসব পরিস্থিতির কারণে অনেক সিনেমা হল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও মনিহারও মাঝে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ব্যবসায় চরম মন্দার ওপর সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি ও হামলার কারণে মালিক হলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে, পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ও আশ্বাসের কারণে ফের চালু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এ প্রেক্ষাগৃহ।
মনিহারের পাশাপাশি যশোর শহরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টিকে থাকা আর একটি সিনেমা হল হলো-তসবির মহল। এ হলের অবস্থা আরও করুণ। অর্ধশত বছরের পুরানো এ হলের সেই জৌলুস আজ আর নেই।
তসবির মহলের ব্যবস্থাপক উত্তম সরকার বাংলানিউজকে জানান, এ হলে ৬৭৫টি আসন রয়েছে। সপ্তাহের শুরুতে নতুন সিনেমা লাগালেও প্রথম দিকের শো’তে অর্ধেক দর্শকও হয়না। আর দু’দিন পার হওয়ার পর দর্শক অভাবে শো বন্ধ রাখতে হয়।
অব্যাহত লোকসানের মুখেও কোনোমতে হলটিকে চালু রেখেছেন বলে জানান উত্তম সরকার।
যশোর শহরে এ দু’টি হল চালু থাকলেও হারিয়ে গেছে নিরালা, চিত্রা ও মানসী সিনেমা হল।
বছর তিনেক আগে নিরালা সিনেমা হল ভেঙে ফেলে সেখানকার জমি প্লট আকারে বিক্রি করা হয়েছে। এর পরপরই উপশহরের মানসী সিনেমা হলটিও বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ভবন।
সর্বশেষ চলতি বছরেই শহরের প্রাণকেন্দ্র চিত্রা মোড়ের চিত্রা সিনেমা হলটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। যদিও কয়েক বছর ধরেই হলটি বন্ধ ছিল। পরে সেটি বিক্রি হয়ে যাওয়ায় সেখানে এখন নির্মাণ হচ্ছে আবাসিক হোটেল।
শহরের এ চিত্রের পাশাপাশি গোটা জেলার অবস্থাও একই রকম।
জেলা তথ্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে জেলার ৮টি উপজেলায় মোট ২২টি সিনেমা হল গড়ে ওঠে।
যার মধ্যে যশোর শহরে ৫টি ও সদরের রূপদিয়ায় ১টি, বাঘারপাড়া উপজেলায় ১টি, মণিরামপুর উপজেলায় ৩টি, কেশবপুর উপজেলায় ২টি, অভয়নগরে ৩টি, চৌগাছায় ২টি, ঝিকরগাছায় ২টি ও শার্শায় ৩টি সিনেমা হল রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে।
বন্ধ হওয়া সিনেমা হলের যন্ত্রাংশ, আসবাবপত্র ও অন্য সামগ্রীসহ কয়েক কোটি টাকার মালামালও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন অন্তত ৪শ কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে গিয়ে মনিহার সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, মূলত চলচ্চিত্র শিল্পের ধসের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
একদিকে, ভালো মানের নায়ক, নায়িকাসহ শিল্পী সংকট। অন্যদিকে, মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি না হওয়া। এসব কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিপুল সংখ্যক দর্শক সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
তিনি উল্লেখ করেন, মাঝে মধ্যে সুস্থ্য, সামাজিক ও বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে তা দেখতে এখনও মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সুতরাং মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি করা গেলে দর্শকের অভাব হবে না। আর সিনেমা হলগুলো আবার জেগে ওঠবে।
তসবির মহলের ব্যবস্থাপক উত্তম সরকারের মতে, আকাশ সংস্কৃতি আর স্যাটেলাইট চ্যানেলের কারণে মানুষ ঘরে বসেই অসংখ্য সিনেমা দেখতে পারছে। আবার শহর ও গ্রামের চায়ের দোকানেও সিডি প্লেয়ার ও কেবল সংযোগের মাধ্যমে সকাল-সন্ধ্যা সিনেমা দেখানো হচ্ছে।
এ কারণেও হলগুলোতে দর্শক হচ্ছে না।
সিনেমা এবং হলগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোর শাখার সভাপতি হারুন-অর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে আজ মানুষ ঘরে বসেই সিনেমা উপভোগ করতে পারছেন। ঘরে বসেই বিনোদন পাওয়ায় হলমুখিতা কমেছে।
তবে, সিনেমা হল থেকে দর্শকদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অন্যতম কারণ অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ সিনেমা।
নিম্নশ্রেণীর দর্শকদের আকৃষ্ট করতে এক সময় ঢাকার সিনেমায় শুরু হয় অশ্লীলতার প্রতিযোগিতা। এ কারণে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মধ্যবিত্তদের সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে এখন মাঝে মধ্যে ভালো ছবি হলেও দর্শকপ্রিয়তা পেতে কষ্ট হয়।
এর পাশাপাশি এখন সিনেমা হলের পরিবেশও ভালো নেই। মাস্তান, সন্ত্রাসীদের আখড়ায় পরিণত হওয়ায় সাধারণ মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেও নিরাপদ বোধ করে না।
চলচ্চিত্র শিল্পের সার্বিক বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে যশোর ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল আলম সোহাগ বাংলানিউজকে জানান, এক সময় ছেলে, বুড়ো, নারী, পুরুষ একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতো। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই।
অব্যাহতভাবে নিম্নমানের সিনেমা তৈরি সেই অবস্থাকে পতনের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারেক মাসুদ, হুমায়ূন আহমেদের মতো গুণী মানুষকে আমরা হারিয়েছে। যারা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে চলচ্চিত্রের সুস্থ ধারাকে টিকিয়ে রেখেছিলেন।
গতানুগতিক কাহিনীর অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ সিনেমার কারণে সিনেমা হলগুলো আজ দর্শকহীন থাকছে। ফলে হল মালিকদেরও ব্যবসা হচ্ছে না, আর সিনেমার পেছনে লগ্নি করা অর্থও প্রযোজক পরিচালকরা তুলতে পারছেন না।
এ কারণে চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে তিনি সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপের দাবি করেছেন। তার মতে, চলচ্চিত্র শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজকসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
এছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সুস্থ চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটিয়ে হলবিমুখ দর্শকদের সিনেমা হল মুখী করতে হবে। এজন্য বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল ফরম্যাটে সিনেমা করতে হবে।
পাঠক আগামীকাল শনিবার থাকছে বাগেরহাটের সিনেমা হলগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন।
বাংলাদেশ সময়: ০০০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১,২০১২
সম্পাদনা: মাহাবুর আলম সোহাগ, নিউজরুম এডিটর