মানুষ বলেই জীবনটাকে ছোট্ট সেলুলয়েডের ফিতায় খণ্ড-খণ্ডভাবে বহুমাত্রিক করে তুলতে পারেন। আবার মানুষের জীবনটাই খণ্ড-খণ্ড চিত্রে সেলুলয়েডের ফিতায় বাঁধা পড়ে হয়ে ওঠে আপাতদৃষ্টিতে পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য।
তিনি বড় হয়েছেন গ্রামে। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ কলেজে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ১৯৮২ সালের উত্তাল রাজনৈতিক সময়ে। চাকরির কথা কিছুতেই তার মাথায় আসতো না। বন্ধুরা যখন ভাবতো কবে পাস করবো, আর চাকরি করবো, তখন তিনি ভাবতেন আরও কতদিন এভাবে থাকা যায়। সেশনজটটাই বেশি ভালো লাগতো তার।
ছোটবেলায় খুব ভালো ফুটবল খেলতেন নূরুজ্জামান। এলাকার সব মাঠে ফুটবল খেলেছেন। কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় ক্রিকেটও খেলেছেন অন্যদের চেয়ে আগে। বুনো আমড়া আর নারিকেলের ডেগো দিয়ে খেলেছেন ক্রিকেট। ভলিবল খেলেছেন তালপাতা আর নাড়া দিয়ে তৈরি বলে। পানির মধ্যে ভিজিয়ে রেখে টেকসই করা হতো সে বল। তবু খেলা চাই।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা পানিয়া গ্রামে ফিরে এসে একটি ক্লাব করেন। নাম দিলেন পানিয়া জনকল্যাণ সমিতি। ওখানে ছিল অনেক বই। ওই ক্লাবে তার বড় মামা সেক্রেটারি হন। কিন্তু বইগুলো একসময় কেউ পড়তো না। ওসব বইয়ের জায়গা হলো একটি প্রাইমারি স্কুলে। তখন মামার কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে বই পড়ার নেশায় পড়েন তিনি।
আরও পড়ুন: সুন্দরের শীলন- সুশীলন
ইন্টারমিডিয়েটে এসে দুজন শিক্ষক গাজী আজিজুর রহমান ও গাজী আবুল কাশেমের সান্নিধ্যে খেলার জগৎ হয়ে যায় সংস্কৃতির জগৎ। তখন সুমন সাহিত্য গোষ্ঠী নামে কলেজে একটি সংগঠন তৈরি করেন। সেটাই সংগঠন তৈরি শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সরদার ফজলুল করিমের সহযোগিতায় লাইসিয়াম নামে একটি স্ট্যাডি সার্কেল গড়ে তোলেন। দু’বছর চালান সেটা। কিন্তু দর্শনচর্চা থেকে হঠাৎ করে মাথায় ঢুকলো ফিল্ম ডিরেক্টর হতে হবে। যাওয়া শুরু করলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। কামরুল হাসান মঞ্জু, মিজারুল কায়েসের কাছে শিখলেন আবৃত্তি। কিন্তু বেশিদিন থাকা হলো না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ছেড়ে আরণ্যক নাট্যগোষ্ঠীতে যোগ দিলেন। সেখানেও থিতু হলেন না বেশিদিন। এরইমধ্যে বিপ্লব বালা একটি আবৃত্তি সংগঠন করেন কণ্ঠশীলন নামে। যেটার সঙ্গে সুশীলন নামের একটি যোগ আছে। কণ্ঠশীলনে ভর্তি হওয়াটাও ছিল বড় একটি ঘটনা। কারণ পরীক্ষায় ওয়েটিংয়ে থাকলেন। কিন্তু আগ্রহ দেখে ফর্ম বিক্রেতা ভর্তির সুযোগ দিলেন।
সেখানে চারমাসের কোর্সে বেশিকিছু না শিখতে পারলেও প্রথম আবর্তনের সার্টিফিকেট বিতরণ অনুষ্ঠানে বিপ্লব বালা পারফরমেন্সের জন্য যেটা শেখান মূলত আসল আবৃত্তি তখনই শিখে ফেলেন। যার চর্চা এখনও আছে শত ব্যস্ততার মধ্যেও। রবীন্দ্রনাথের শিশুতীর্থ থেকে শুরু করে অসংখ্য কবিতা নিজস্ব ঢংয়ে আবৃত্তি করে আসর জমান এখনও।
এরপর প্রচুর সিনেমা দেখতে শুরু করেন তিনি। পড়াশুনাও করেন সিনেমার নানা বিষয়-আশয় নিয়ে। কারণ তাকে সিনেমা বানাতে হবে। কিন্তু ভাবতেন যে সিনেমা বানাবেন সেটি দেখবে কে, আর অর্থই বা আসবে কোথা থেকে। তখন ইমলাজ গুনিন নামে একজন তুরস্কের চলচ্চিত্র নির্মাতার মাধ্যমে দারুণভাবে আকৃষ্ট হন। কান চলচ্চিত্রে তার পলিটিক্যাল ছবি খুব নাম করে।
আরও পড়ুন: সুশীলনের ব্যাঘ্রতট থেকে সুন্দরবনের হাতছানি
ইমলাজ গুনিন যেহেতু আর্টফিল্ম বানাতেন, তার ফিল্মে কেউ টাকা দিতো না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাণিজ্যিক সিনেমার নায়ক হয়ে অর্থ উপার্জন করে সেই অর্থ দিয়ে সিনেমা বানাবেন। তিনি করলেনও তাই। তখন পাগলাটে স্বভাবের নূরুজ্জামানও ঠিক করলেন ইমলাজের পথ ধরবেন। কিন্তু ভিতর থেকে তাগিদ এলো, তার আগে তো আবৃত্তি শেখা চাই। সেটাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। আবৃত্তিই যে তার মনটাকে পাল্টে দেবে এটা আগে বোঝেননি।
চাকরি করবেন না, এটা বরাবরের সিদ্ধান্ত ছিল। তার মনে হতো স্বাধীন-স্বাধীন একটা ব্যাপার আছে চাকরি না করার মধ্যে। অথচ চাকরিই করেননি তখন, স্বাধীন-পরাধীন বুঝবেন কীভাবে- এ ভাবনাও ছিল। গ্রাম উন্নয়ন নিয়ে কাজ করবেন, গ্রামে ফিরে যাবেন। মূল ধারণা ছিল এটা। গ্রামে তো তখন চাকরি নেই। তখন এভাবে এনজিও বিকশিত হয়নি।
এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পড়াশুনায় চলে গেলেন। এখানে তার জীবনগতি পাল্টানোর উপাদান ছিল। বিষয়গত কারণে পলিটিকস অ্যান্ড পারসোনালিটিজ ইন সাব-কন্টিনেন্ট বিষয়ে পড়াশুনা করেন।
পলিটিকস অ্যান্ড পারসোনালিটিজ ইন সাব-কন্টিনেন্ট বিষয়ে পড়তে গিয়ে গান্ধীর জীবনী দিয়ে প্রভাবিত হলেন মারাক্তকভাবে। ওইসময় গান্ধী সিনেমাটি অস্কার পায়। জীবনী পড়লেন, আবার অস্কার পেলো সিনেমা। তখন প্রভাব আরও বেড়ে গেলো। বন্ধু সাইদুল ইসলাম মিঠু পাটগ্রামে চলে যান আলুচাষি হবে বলে আর মোস্তফা নূরুজ্জামান গ্রামে।
আরও পড়ুন: বনরক্ষী দিয়ে সুন্দরবন ট্যুরিজম হবে না
গ্রামে যাবেন বলে আবার ‘ল’ পড়লেন। গিয়ে ক্লাব অর্গানাইজ করে বেড়াবেন। তখনই মামা এম এ রশীদ বললেন, তিনি একটি এনজিও করতে চান। তখন তিনি এনজিওবিরোধী। এনজিও নাকি সাম্রাজ্যবাদের দালাল। আবার গ্রামে ফিরে যেতে হবে। কি করবেন গ্রামে ফিরে। তখন মিঠু বললো যতই দালাল বলুক চেষ্টা করে দেখো। সেই সাহস নিয়ে তখন মানবসম্পদ উন্নয়ন নামে একটি এনজিও করলেন মামার অর্থায়নে ১৯৮৮ সালে। কিন্তু বেশিদিন কাজ করা হয়নি।
এর আগে ছোট ভাইদের নিয়ে একটি সংগঠন করেন কণ্ঠশীলন প্রভাবিত হয়ে। ভাইয়েরা তখন ক্লাস সিক্সে পড়েন। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামে যারা পড়াশুনা করছে তাদের সাহায্য করতে হবে। যখন মানবসম্পদ ছেড়ে দেন, তখন নিজে কিছু করার চিন্তা করেন। ভাইদের নিয়ে গড়া সেই সংগঠনটির নাম ‘সন্দীপন’ দিয়ে সুশীলন নামটি নিজের করে নেন। গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান সুশীলন। যেখানে হবে সুন্দরের অনুশীলন। সু-শীলন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে সুশীলন গঠন। বিষয়টি ভাবাচ্ছিলো আড্ডায়। তিনি বললেন, বংশের কেউ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি। বাবা মনে করতেন ছেলে বাড়ি ফিরে কিছু একটা হবে। কিন্তু বাবার কিছুটা হতাশার মধ্যেই সুশীলন গড়ে তুলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে সেই গ্রামে ফিরে গেলাম। ঢাকায় বসেও হয়তো এনজিও করা যেত। কিন্তু ঢাকা আমার ভালো লাগে না, যদিও খুলনা পর্যন্ত আমরা এসেছি। দেশের ৪২টি জেলায় কাজ করছি। পরে বাবা বোঝেন আমি একটি ভালো কাজ করছি।
গ্রামে গিয়ে কি মনে হয়, সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল? তখন উপমহাদেশের বিখ্যাত ফিল্ম মেকার ঋত্বিক ঘটকের উদাহরণ টেনে বলেন, ঋত্বিক সেলুলয়েডের ফিতায় মদ ঢেলে দিয়ে বলতেন, ‘আমি কিছু করতে পারলাম না। ওনার কথাটাই আমি প্রতিধ্বনিত করলাম। ’
বাংলাদেশ সময়: ২৩৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৭
এএ