রাত সাড়ে ৮টায় মলয় তার ফেসবুক পেজে প্রথমে পোস্ট করেন, ‘কথা দিয়েও বাংলাদেশি প্রকাশকরা আমার বই ছাপেননি’। তার এই স্ট্যাস্টাসের পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ফেসবুক ব্যবহারকারী বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাংলাভাষী পাঠকদের মধ্যে।
এখানে বাংলাদেশি তরুণ প্রকাশক ও ভাষাচিত্র প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী খন্দকার সোহেল উষ্মা প্রকাশ করে প্রবীণ এই কবির কাছে জানতে চান ‘কয়জন প্রকাশক?’
এরপরই মলয় রায়চৌধুরী তার ফেসবুক ওয়ালে আবার লেখেন, ‘বাংলাদেশের বইমেলায় আমার বই নেই। সেখানকার প্রকাশকরা মৌলবাদী। ’
এই মন্তব্যের পরই ফেসবুকে ঝড় তোলেন দুই দেশের বাংলা ভাষাভাষী কবি, লেখক, প্রকাশক ও পাঠকরা। এই স্ট্যাটাসে কমেন্ট করে কবি কাজী নাসির আলী মামুন লিখেছেন, ‘ঢালাও মন্তব্য আশা করি না, মলয় দা। বাংলাদেশের পাঠক এবং প্রকাশকরাও যথেষ্ট উদার। বাংলাদেশের বই গ্রহণে পশ্চিমবঙ্গই এখনো উদার হতে পারেনি। আশা করি বিষয়টি বিবেচনা করবেন। ’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কবি শামীম রেজা তার মন্তব্যে লিখেছেন, ‘মৌলবাদী তো শুধু জানতাম কলকাতার প্রকাশকরা,আপনাদের অনেকেরই বই আছে, পড়ে এখানের পাঠক, ওখানে আমাদের বই পড়ার লোক বন্ধুরা ছাড়া কেউ নেই, আগ্রহ নেই..। ’
দীপু মাহমুদ লিখেছেন, ‘মলয় দা, আমার মনে হয় আপনার এই মন্তব্য থেকে সরে আসা উচিত। আপনার বই প্রকাশ করেনি বলে বাংলাদেশের প্রকাশকরা মৌলবাদী এই মন্তব্য যেমন ব্যাখ্যা দাবী করে তেমনি আপনাকে পঙ্কে নামায়। ’
আবার কোলকাতার কবি কাজল দাস লিখেছেন, ‘মলয়দা বাংলাদেশ রাষ্ট্রটাই তো এখন মৌলবাদী, তাঁর প্রকাশকরা তো মৌলবাদী হবেনই, এরা মেরুদন্ডহীন। চেতনা বলতে কিছু এই দেশের কম প্রকাশকদেরই আছে। যে কয়জন আছেন, এরা ও তাঁদের কারণে কোনঠাসা হয়ে থাকেন। ’
পশ্চিমবঙ্গের কবি নীলাঞ্জন সাহা লিখেছেন, ‘আপনার বই নেই মানেই মৌলবাদী? বড্ড ছেলেমানুষের মতো কথা হয়ে গেল। আমরাই বরং বাংলাদেশের লেখকদের বই ঠিক মতো পাই না। ’
জলপাইগুড়ির কবি গৌতম গুহ রয় লিখেছেন, ‘মৌলবাদী বললে কলকাতার সেই সব প্রকাশকদের বলতে হয় যারা দীর্ঘকয়েক দশক অই বাংলার অসাধারণ সব সাহিত্যিকদের বই এই বাংলার পাঠকদের নাগালের বাইরে রেখে দিয়েছিলো,বইবাজারে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার জন্য খন্ডিত বাংলা সাহিত্যের পসরা সাজিয়ে সেটাই সমগ্র বলে এপারের সাহিত্য পাঠককে বঞ্চিত করেছে,এপারে অপরিচিত থেকে গেছেন শহিদুল জহীর, কায়েস আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, প্রভৃতি সাহিত্যিকেরা। ’
কবি সৈকত দে তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘যত বয়স বাড়ছে মলয় রায়চৌধুরীর উপর শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলছি। আমার শৈশবে অতি কষ্টে সংগ্রহ করা হাওয়া ৪৯ পত্রিকা এবং লেখালেখিতে যে মলয়দাকে আমি চিনতাম তিনি কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এখন এই আইডি যে লোকটা চালায় তাকে আমার অচেনা লাগে। তাই আনফলো করে দিলাম। স্বর্গত মলয় রায়চৌধুরীর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এই লোকটা লিখেছে- বাংলাদেশের বইমেলাতে তার বই পাওয়া যায় না। প্রকাশকরা মৌলবাদী।
প্রসঙ্গত,১৯৬১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করেন মলয় রায়চৌধুরী, তাঁর বন্ধু দেবী রায়, বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী ও কবি শক্তি চট্টোপ্যাধ্যায়। পরবর্তীকালে উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, সুবিমল বসাক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র এবং তার বান্ধবী আলো মিত্র, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরীসহ আরো অনেকে। ১৯৬৪ সালের হাংরি বুলেটিনে মলয় রায় চৌধুরী’র ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা প্রকাশিত হয় এবং ‘হাংরি বুলেটিন ১৯৬৪’ প্রকাশের পরে ভারতীয় আদালতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
১৯৬৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর হাংরি আন্দোলনকারীদের ১১ জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ড বিধির ১২০বি (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ), ২৯২ (সাহিত্যে অশ্লীলতা ) ও ২৯৪ (তরুণদের বিপথগামী করা) ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়; এদের ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৫ সালের মে মাসে অন্য সবাইকে রেহাই দিয়ে কেবল মলয় রায় চৌধুরী’র বিরুদ্ধে ২৯২ ধারায় চার্জশিট দেয়া হয়। গ্রেফতারি পরোয়ানার দরুন উৎপলকুমার বসু অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। প্রদীপ চৌধুরী বিশ্বভারতী থেকে রাসটিকেটেড হন। সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন। সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতা থেকে মফঃস্বলে বদলি করে দেয়া হয়।
গ্রেফতারের সময়ে মলয় রায় চৌধুরীকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে দুই কিলোমিটার হাঁটিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে ব্যাংকশাল কোর্ট মলয় রায় চৌধুরীকে দুশো টাকা জরিমানা, অনাদায়ে একমাসের কারাদণ্ড দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে মলয় রায় চৌধুরী কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন এবং ২৬ জুলাই ১৯৬৭ সালে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭
আরএম/জেএম