গৃহস্থ থেকে শুরু করে সচ্ছল- সবার ঘরেই ফুরিয়ে এসেছে খোরাকির ধানও। ফলে সামনে তাদের ঘোর অন্ধকার।
চৈত্রের অথৈ জল এমন সর্বনাশ ডেকে আনায় ভাগ্যকেই বার বার দোষারোপ করছিলেন আব্দুল কদ্দুস- ‘হাওর ভাত দেয় না, গৃহস্থরেই মারে’।
ফসল নিয়ে স্বপ্ন বোনার ক্ষণেই সব হারানোর দগদগে ক্ষতটা শহীদের বুকেও। পাহাড়ি ঢলের আগাম বন্যায় হাওরের বুকে মিশে গেছে তার সাড়ে ৭ একর জমির ধান।
ফসল ঘরে তোলার আনন্দের সময়েই ভয়াবহ এ বিপর্যয় সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছে ইসলামপুর গ্রামের সব মানুষকেই। সর্বনাশা বল্লির হাওর বোরো ফসল ছাড়াও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ইকুরদিয়া লঞ্চঘাট ঘেঁষা গ্রামটির উত্তর পাশের ভুট্টা, মিষ্টি আলু ও বাদামের ক্ষেত।
কঠোর শ্রম-ঘামে বোনা ফসল তলিয়ে যাওয়ায় স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাতর এখন অষ্টগ্রাম বড় বাজার থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের এ গ্রামের প্রান্তিক চাষিরা।
গ্রামটির উত্তর দিকে বয়ে চলেছে মেঘনার শাখা নদী। তার আগে ইকুরদিয়া লঞ্চঘাট বাজার। বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে বসে অকাল ঢলের পানিতে বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল হারানোর বেদনায় হাঁস-ফাঁস করছিলেন কৃষিজীবী মানুষেরা।
এদিকে জলে ডুবন্ত স্বপ্নকে পুনরুজ্জীবিত করা প্রাণপন চেষ্টা চালিয়েও পারেননি মফিজুল (৩৪)।
শরীরে কম্বল মুড়িয়ে বাজারে আসা মফিজুল জানালেন, হাওরে তলিয়ে থাকা নিজের রোপণ করা ধান তুলে আনতে গিয়েও পারেননি। উল্টো ভরা হাওরের পানির তোড়ে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে তাকে। বুক সমান ঠাণ্ডা পানিতে টিকতে না পেরে ঘরে ফিরেছেন। আবাদ করেছিলেন তিন কানি (একর) ফসল। সঙ্গে আনতে পারেননি এক ছটাক ধানও।
ঘাটের তীরে ভেড়ানো কাঁচা ধানে ভরা দুই নৌকায় তখন কাঁদছিলেন কয়েকজন কৃষক। বেঁচে থাকার অবলম্বনই মাটিচাপা দিয়ে এসেছেন তারা।
তলিয়ে যাওয়া ফসল আর পানিতে ভাসার কোনো সম্ভাবনা নেই, জানালেন হাজীবাড়ির জমির হোসেন। নিজের ৮ একরের ধানক্ষেত নদীর পেটে ঢুকে যাওয়ার কষ্টে কাতর তিনিও।
৮ একর বাদামের ক্ষেত হারিয়ে কথা বলার শক্তিই হারিয়ে ফেলেছেন গোড়ারপাড়ের আক্কাছ আলী। চল্লিশোর্ধ্ব এ কৃষক জানালেন, চৈত্র মাসেই এমনটি ঘটে যাবে, ভাবতে পারেননি। বছরের একমাত্র ফসল কাঁচা অবস্থায় তলিয়ে গেছে। কঠিন এ দু:সময়ে কষ্টে ফলানো বাদামের ক্ষেতেরও একই দশা তাকে একেবারে পথে বসিয়ে ছেড়েছে।
হাহাকার করে ওঠা আক্কাছ যেন গোটা গোড়ারপাড়ের প্রতিচ্ছবি।
মানবিক বিপর্যয়ের সারি সারি চিত্রপট রচনা করা হাওরে মরে ভেসে উঠছে পুঁটি, বাইল্ল্যাসহ নানা প্রজাতির মাছ। গ্রামের ফসল শুকানোর খলাটিও পানিতে টইটম্বুর। কোথাও ধান শুকানোর সামান্যতম জায়গাও নেই।
এখান দিয়ে হাঁসের পাল ছুটে গেলেও পচা খড়ের গাঁদায় মুখও দিচ্ছে না।
হাওরের জীবনকে অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দেওয়া অকাল বন্যায় দুশ্চিন্তা ভর করেছে জনপ্রতিনিধিদের মাঝেও। ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম জানান, ফসল হারানোর হাহাকারে ভারী গ্রামটিতে সাহায্যের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
** হাওরে দুর্যোগে নেই পাউবো-এলজিইডি!
** ‘হাওর ভাত দেয় না, গৃহস্থরেই মারে’
** কলাগাছের ভেলাই যেন হাওরে ‘সোনার তরী’!
** হাওর বধূদের মুখেও আঁধার!
** হাওরে কৃষকদের দুর্দিনে মাথায় হাত চাটাই ব্যবসায়ীদের
** চোখ-নদীর জল একাকার হাওরের জলে!
** হাওরে বিদ্যুৎ যায় না, আসে!
** শুন্য হাতে ফিরছেন ‘জিরাতিরা’
বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৭
এমএএএম/এএসআর