হাজারো গাছ-গাছালির ঝিরঝিরে বাতাস কড়া রোদের তাপে ঘেমে-নেয়ে ক্লান্ত শরীরকে ফুরফুরে করে দিলো। তবে চোখে শীতলতা আনলো কেবলই দিঘীর বিশালতা।
৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯২ বর্গমিটারের এ দিঘীর বিশালতার বর্ণনায় আর কিইবা আসবে ভ্রমণপিপাসুর মুখে? দিনাজপুর শহরের মূলকেন্দ্র থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে অবস্থিত ‘রামসাগর’ দেশের সবচেয়ে বড় দিঘী বলে এতোদিন বই-পত্রিকায় পড়া হয়েছে, এবার একেবারে স্বচক্ষে দেখা। দৈর্ঘ্যের এক প্রান্ত থেকে তাকিয়ে অপর প্রান্তের কিনারা অনুমান করা যায় না। অপর পাশে কী, সে তো বোঝা মুশকিলই বটে। প্রস্থের এক প্রান্ত থেকেও অপর প্রান্তে তাকিয়ে কাউকে চেনার কোনো সুযোগ নেই। বিশালতা বোঝানোর জন্যই বুঝি ‘রামসাগর’ নামকরণের পেছনে দৈবিক বা স্বপ্নাদেশের লোককাহিনী।
যেমন প্রচলিত আড়াইশ’ বছরেরও বেশি সময় আগের লোককাহিনীটি— দিনাজপুরে তিন শতাধিককাল রাজত্ব করা রাজবংশের শ্রেষ্ঠতম রাজা রামনাথ তখন সিংহাসনে। সুশাসক এ রাজার রাজ্যে একটানা অনাবৃষ্টি দেখা দিলো, দেখা দিলো খরা ও দুর্ভিক্ষও। প্রজাপ্রিয় রাজা জনগণের জন্য খুলে দিলেন রাজভাণ্ডার। এতে খাদ্য সংকটের সুরাহা কিছুটা হলেও দেখা দিলো পানীয় জলের অভাব। খাল-বিল-নদী-নালা সব শুকিয়ে যাওয়ায় কোথাও মিলছিলো না পানি। সারা রাজ্যে শুরু হলো পানির জন্য আহাজারি। এমন অবস্থায় রাজা একটি বিরাট দিঘী খনন করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হলো দিঘী খনন। হাজারো শ্রমিক মতান্তরে ১৫ লাখ শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে খনন করে এক বিশাল দিঘী। কিন্তু বিশাল ও গভীর হওয়া সত্ত্বেও দিঘীর বুকে এলো না একফোঁটা পানি। বয়োজ্যেষ্ঠ রাজা হতাশা ও দুর্ভাবনায় আহার-নিদ্রা ছেড়ে দিলেন। একদিন স্বপ্নাদেশ পান, দিঘীতে যুবরাজ রামকে বলি দিলেই পানি উঠতে শুরু করবে। এ স্বপ্নাদেশের খবরে রাজপ্রাসাদ ছাড়িয়ে পুরো রাজ্যেই রোনাজারি শুরু হয়। কিন্তু রাজা রামনাথের মতো যুবরাজ রামও ছিলেন প্রজা অন্তঃপ্রাণ। তিনি আত্মদানের বিনিময়ে রাজ্যের প্রজাদের পানিসংকট দূর করতে বদ্ধপরিকর অবস্থান জানালেন। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, দিঘীর মাঝ বরাবর ছোট্ট একটি মন্দির নির্মাণ করা হলো। রাজা-প্রজাদের বিদায় দিয়ে যুবরাজ সাদা পোশাকাচ্ছাদিত হয়ে হাতির পিঠে চড়ে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে দিঘীর তলা থেকে বাণের মতো পানি উঠতে থাকলো। পানিতে টইটম্বুর হয়ে উঠলো দিঘীটি। তলিয়ে গেলেন যুবরাজ।
যদিও কেউ কেউ বলে থাকেন, প্রজাদের পানীয় জল নিশ্চিত করতে রাজা রামনাথ দিঘীটি খনন করেছিলেন বলেই এটির নামকরণ করা হয়েছে ‘রামসাগর’। গ্রহণযোগ্য মতের মধ্যে রয়েছে, দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে অভাব দূর করার জন্য রামনাথের এ দিঘী খনন প্রকল্প হাতে নেওয়ার বিষয়টিও।
বিশাল এ দীঘির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ মিটার। প্রস্থ ৩০৪ মিটার। গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। ইতিহাসবিদদের মতে, দিঘীটি রামনাথের শাসনকালের (১৭২২-১৭৬০) শেষভাগে ১৭৫০ থেকে ১৭৫৫ সালের মধ্যে অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের আগে খনন করা হয়।
দিঘীটিকে বনবিভাগের আওতায় আনা হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৯৫-৯৬ সালে এটিকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। আর রামসাগরকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০০১ সালে। এই ঐতিহাসিক দিঘীটি এখন দিনাজপুরসহ সারাদেশের ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। বিশেষত ছুটির দিনগুলোতে এখানে আগ্রহীদের ভিড় জমে। আয়োজন হয় বনভোজনেরও।
মূল দিঘীর চারপাশেই আছে প্রশস্ত রাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে একপাশে জল, অন্যপাশে ছোট ছোট টিলার ওপর গাছ-গাছালির বন- এমন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ হৃদয়কে আন্দোলিত করবে। আর যদি আয়োজন করে গোসল করা যায়, তবে গোসল সেরে ওঠার পর শরীরের ওপর বাতাসের পরশ ভ্রমণপিপাসু মনকে নাচিয়ে তুলবে শৈশবের আনন্দ। রামসাগর জাতীয় উদ্যানে একটি মিনি চিড়িয়াখানা রয়েছে। সেখানে রয়েছে হরিণ, বানর ও অজগর। শিশুদের জন্য আছে বিভিন্ন পশু-পাখির অবয়ব দিয়ে গড়া একটি পার্ক। রয়েছে রামসাগর এক চক্কর নৌভ্রমণের সুযোগ এবং দিঘীর পাড়ে ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থাও। আছে বন বিভাগের রেস্ট হাউসও, যেখানে রুম ভাড়া নিয়ে থেকে সকাল-সন্ধ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।
যাবেন যেভাবে
ক্লান্ত জীবনকে একটু শান্ত ও স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশে শান্তি নেওয়ার জন্য ছুটে আসতে পারেন দিনাজপুরের এই রামসাগরে। ঢাকা থেকে সড়কপথে যাতায়াত বেশ সহজ। কল্যাণপুর থেকে প্রতিদিনই দিনাজপুরের উদ্দেশে বাস চলাচল করে। দেশের অন্য অঞ্চল থেকেও দিনাজপুরগামী যানবাহন চলাচল করে। দিনাজপুর শহরে নেমে টমটম বা অটোরিকশায় ৩৫-৪০ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রামসাগর জাতীয় উদ্যানে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৭
এইচএ/জেডএম