ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সহিংসতার ধরন পাল্টেছে রাখাইনে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৭
সহিংসতার ধরন পাল্টেছে রাখাইনে সাঁতরে নাফ নদী পার হয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবকের দল। ছবি: উজ্জ্বল ধর

কক্সবাজার: ‘এক ধরনের আগুন আছে, যা জ্বালালে দূর থেকে দেখা যায়, ধ্বংসযজ্ঞ চোখে পড়ে। আর এক ধরনের আগুন আছে, যার লেলিহান শিখা দূর থেকে দেখা যায় না। এমন আগুনে কোনো ধ্বংসযজ্ঞ হয়তো চোখে পড়ে না, কিন্তু তা আরো বেশি মারাত্মক তাপ উদগীরণ করে। প্রাণহীন করে ফেলে পুরো এলাকাকে।’

দিন দুয়েক আগের কথা। বালুখালির হাকিমপাড়া অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে এভাবেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দ্বিতীয় দফার চলমান সহিংসতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মংডুর বইল্যাপাড়া ইউনিয়নের চারবারের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান জাফরি।

তিনি যখন কথা বলছিলেন, তখন তার শরীর কাঁপছিলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলেও দৃষ্টি ছিলো কেমন এলোমেলো। তবে কন্ঠে ছিলো দার্শনিকের মতো গাম্ভীর্য। আজ যখন প্লাস্টিকের জারিকেন নিয়ে ১১ রোহিঙ্গা যুবক তিন কিলোমিটার প্রশস্ত নাফ নদী সাঁতরে বাংলাদেশের শাহপরী দ্বীপে এসে পৌঁছুলো, তখন মিয়ানমারের চলমান নিপীড়নের আঁচ সত্যিই পাওয়া গেলো। কেননা, ২ দিন আগের  নৌকাডুবিতে এখন পর্যন্ত নিহত ২৯ জনের ডুবে মরার স্মৃতিও ওদের দমাতে পারেনি। নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশের কাছাকাছি থেকে তাদের উদ্ধার করেছে উপকূল রক্ষী বাহিনী বা কোস্ট গার্ড।

কোস্টগার্ডের শাহপরী দ্বীপ স্টেশন ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জাফর ইমাম সজীব বাংলানিউজকে বলছিলেন, উদ্ধার হওয়া ১১ জনের সবাই তরুণ ও তারুণ্যে পৌঁছাতে যাওয়া কিশোর।

এসব তরুণ ও কিশোরের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, আকিয়াব থেকে মংডু, সবখানেই সে দেশের সেনাবাহিনীর তীব্র দমন-নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। আজও (বুধবার) মংডু শহরের উপকন্ঠের কয়েকটি গ্রামে তীব্র সহিংসতা চালানো হয়েছে।

মঙ্গলবার বাংলাদেশে আসা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেনাবাহিনী ও রাখাইন মগরা এখন আক্রমণের ধরন কিছুটা পাল্টে ফেলেছে। তারা এখন অগ্নিসংযোগ কমিয়ে আক্রমণের ভয়াবহতার ধার তীক্ষ্ণ করেছে। আগে কোনো মেয়েকে ধরে নিয়ে গণধর্ষণ করে মেরে ফেলতো। আর এখন ধর্ষণের পর মেয়েটির স্তন ও যৌনাঙ্গ কেটে নেয়া হয়, এতে মেয়েটি রক্তক্ষরণ জনিত কারণে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। প্রতি রাতেই প্রতি গ্রামেই এ ঘটনা ঘটছে।

মংডুর উপকণ্ঠের এক মুসলিম ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, আগুন লাগালে বাংলাদেশ থেকে তা দেখা যায়। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তার ছবি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। তাই সপ্তাহখানেক ধরে আর আগুনের আধিক্য নেই হামলায়। এখন নীরব আগুনে পোড়ানো হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের। বাবার কাছ থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে। সন্তানের সামনে ধর্ষিত হচ্ছেন মা। ফলে বাংলাদেশে পালানো ছাড়া আমাদের আর কি করার আছে! হয়তো আর কখনোই আমাদের মাতৃভূমিতে ফেরা হবে না।

তিনি বলেন, ১৯৫৩, ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২ বা ২০১৬ ও ২০১৭ এর নিপীড়ন এক নয়। সেনাবাহিনী এবার রোহিঙ্গা মুসলমানদের রাখাইন রাজ্য থেকে স্থায়ীভাবে বিতাড়িত করার সব চেষ্টাই করেছে। এজন্যই তারা এবার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম ও পরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে।
 
বালুখালিতে পালিয়ে আসা একজন রোহিঙ্গা রাজনীতিক জাফর আলম বাংলানিউজকে বলছিলেন, আমাদের গ্রাম ও ফসলের জমি এমনভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে যাতে আমরা আর কোনো দিন সেখানে ফিরতে না পারি। এটা ছিল একেবারেই পূর্ব পরিকল্পিত।

তিনি বলেন, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিল ২৫ আগস্ট। কিন্তু তার অনেক আগেই রাখাইনে সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছিল। প্রায় বছর দুই ধরেই  সেখানে কিশোর, তরুণ ও যুবকদের পাইকারি হারে আটক করা হচ্ছিল। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে নেতৃস্থানীয় তাদের আটক করা হচ্ছিল। পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে নির্যাতন, হয়রানি, ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে একটা চরম আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল।

মংডুর ডিওলতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নুর বাংলানিউজকে বলেন, গ্রাম থেকে ধরে নেওয়া যুবকদের সঙ্গে দুই একবার জেলখানায় দেখা করা যায় বটে, কিন্তু এরপর আর তাদের কোন খবর পাওয়া যায় না। কারাগারের অন্ধকারেই তাদের হত্যা করা হয়। বলতে গেলে এভাবেই রোহিঙ্গা সমাজটাকেই এখন যুবক ও তারুণ্য শূন্য করা হয়েছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৭
আরএম/জেডএম        

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।