মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন মগদের পরিকল্পিত ও যৌথ নির্যাতনের মাধ্যমে চালানো জাতিগত নিধন, গণহত্যা, গণধর্ষণ থেকে বাঁচতে এরইমধ্যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বুধবার তেলের জারিকেন নিয়ে টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা সাঁতরে তিন কিলোমিটার নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ পালিয়ে আসেন ১১ যুবক ও কিশোর।
এদিকে আইওএম’র এর হিসাব মতে, গত সোমবার থেকে বুধবার সন্ধা পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। আর জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, কেবল নদী ও সাগর পাড়েই নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে ৯১ হাজার রোহিঙ্গা।
গত ২৫ আগস্টের পর থেকে চালানো সেনা ও মগদের সহিংসতায় উত্তর রাখাইনের বেশির ভাগ গ্রামই এখন স্তব্ধ হয়ে গেছে। সেখানে কোনো কোলাহল নেই। গ্রামের পর গ্রামে কেবল ধ্বংস চিহ্ন। প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই। মগদের লাগানো আগুনে পুড়ে ও ঝলসে যাওয়া গাছগুলোতে পাখিও বসছে না বলে জানালেন একজন প্রতক্ষ্যদর্শী।
মোহাম্মদ নূর নামের এই ব্যক্তি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য রোহিঙ্গাদের দরজা বন্ধ হওয়ার আগের বছরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেটাও ১৯৮৭ সালের কথা। এরপর আর রোহিঙ্গারা সরকারি চাকরির সুযোগ পায়নি।
মোহাম্মদ নূর বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন ২ সেপ্টেম্বর। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালি ইউনিয়নের আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত দিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর ২০ সেপ্টেম্বর তিনি একই সীমান্ত দিয়ে আবার মিয়ানমারে ফিরে যান। কেবল তিনি একা নন, তার সঙ্গে ছিলেন আরো আট শিক্ষক। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বকেয়া বেতন আনার খবর পেয়ে তারা মিয়ানমারে গিয়েছিলেন। প্রায় ১০ দিন টানা হাঁটার পর যখন এলাকায় গিয়ে পৌঁছান তখন তাদের সবাইকে আটক করে সেনাবাহিনী। কেবল তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও বাকিদের ভাগ্যে জুটেছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। ওই আট শিক্ষককে সিটুওয়ে’র নতুন কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।
উখিয়ার বালুখালি, হাকিমপাড়া অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হচ্ছিল এই রোহিঙ্গা শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি তার দেখা গ্রামে যাওয়া ও আসার পথের যে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তা কেবল কল্পনাই করা যায় হয়তো। কখনো কখনো তা কল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের চেয়েও কঠিন , করুণ ও মারাত্মক।
মোহাম্মদ নূর বলছিলেন, পুরো রাখাইনের সব সড়কেই কিছু দূর পরপর সেনা চৌকি রয়েছে। রয়েছে সেনা টহলও। সড়কগুলোতে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। কেবল সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ ও রাখাইন পল্লীর ছোট ছোট টেম্পুগুলো এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় যাতায়াত করছে। তাই আমরা গ্রামের বাইরের যে পাহাড়ি ও জঙ্গলের পথ ধরে বাংলাদেশে এসেছিলাম, সেপথেই গ্রামে ফিরেছিলাম।
তিনি বলেন, এক সময় হাজার হাজার পরিবারের সদস্যদের পদচারণায় যে বসতিগুলো গমগম করতো সেগুলো এখন বিরানভূমি। গ্রামগুলোতে কবরস্থানের নীরবতা। যেখানে সেখানে গলিত ও অর্ধগলিত মুতদেহ ও গবাদি পশুর কংকাল পড়ে আছে। আগুনে পোড়া ও ঝলসানো গাছগুলো এখনো কোনরকম টিকে আছে। কোনো কোনোটা থেকে আবার গজাতে শুরু করেছে নতুন পাতা। ফসলের ক্ষেতের ধান গাছগুলো এখন আরো প্রাণবন্ত ও ধানের ছড়া বের হওয়ার উপক্রম। তবে ক্ষেতগুলোতে যে বহুদিন কৃষকের হাতের ছোয়াঁ নেই তা স্পষ্ট।
বাংলাদেশে পুনরায় ফিরে আসার পথে যে অঞ্চল বা এলাকাগুলো পার হয়েছি, তার পুরোটাই স্তব্ধ এক জনমানবহীন এলাকা। দোকানপাটগুলোও বন্ধ রাখা হয়েছে। বাজারের বেশিরভাগ দোকানই পুড়ে ছাই হয়ে আছে। রাখাইনদের গ্রামগুলোতেও কড়া সেনা প্রহরা রয়েছে। তাদের গ্রামগুলোতে দোকানপাট কিছু খোলা থাকলেও যে দুই/চারজন রোহিঙ্গা এখনো সেখানে রয়ে গেছেন, তারা সেখানে যেতে পারছেন না। তাই অনেকটাই দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তারা টিকে আছেন। অনেক সময়ই তারা পাহাড় ও গভীর জঙ্গল থেকে খাবার সংগ্রহ করছেন বলে জানাচ্ছিলেন মোহাম্মদ নূর।
অন্যদিকে বলিপাড়া এলাকার বাসিন্দা ৬০ বছরের আজারা বেগম বলছিলেন, মংডু ও আশপাশের এলাকায় কোন দোকানপাট খোলা নেই। রোহিঙ্গাদেরই সবচেয়ে বেশি দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। এদের অনেকেই আগে চলে এসেছে। আর যারা আসেনি তাদের দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে মংডু এলাকায় এখন তীব্র খাদ্য সংকট চলছে। যারা এখনো সেখানে আছে, তারাও আর বেশীদিন থাকতে পারবে না। সবারই ঘরের খাবার ফুরিয়ে গেছে। বাজার-দোকনপাট সবই বন্ধ। প্রায় দুইদিন তার পরিবারের ৯ সদস্য খাবার খেতে পারেনি। এ কারণে তারা বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৭
আরএম/জেডএম