ঢাকা, বুধবার, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ০৩ জুলাই ২০২৪, ২৫ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

যুদ্ধের কথা শুনলেই আতঙ্কে কেঁদে ওঠেন কাকন বিবি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৭
যুদ্ধের কথা শুনলেই আতঙ্কে কেঁদে ওঠেন কাকন বিবি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুনামগঞ্জ: ছদ্মবেশে টেংরাটিলা গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন তিনি। তার দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে পরপর পাঁচবার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সফল অপারেশন পরিচালনা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু ষষ্ঠবার পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে যান। টেংরাটিলা পাক ক্যাম্পে বন্দি রাখা হয় কাকন বিবিকে। চালানো হয় অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সেসব ভয়ংকর সব স্মৃতির জন্যই হয়তো যুদ্ধের কথা শুনলেই এখন আতঙ্কে কেঁদে ওঠেন খাসিয়া রমণী কাকত হেনইঞ্চিতা ওরফে নূরজাহান বা কাকন বিবি।

বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের মধ্যে একমাত্র উপাধিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তিনি। ভারতের মেঘালয়ে জন্মগ্রহণ করা এ নারী অনেকটা নাটকীয় ঘটনাচক্রের মধ্য দিয়েই জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে।

ভালোবেসে ফেলেন এদেশের মাটি আর প্রকৃতিকে। এরপর তার নতুন স্বদেশের মর্যাদা রক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী। ব্রত থেকে আর পিছু হটেননি তিনি। এজন্য সয়েছেন নির্মম নির্যাতন আর নিজের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা। সেই ভয়াল স্মৃতি আজো আতঙ্কিত করে তোলে কাকন বিবিকে।

কথা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারিশ আলী’র সাথে। টেংরাটিলায় যুদ্ধ করা এ যোদ্ধা জানান, ‘চারদিন বন্দি থাকার সময় কাকন বিবির ওপর চলে অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। চলতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার সেনা ও বাঙালি রাজাকারদের বিরামহীন ধর্ষণ। এরপর তথ্য আদায়ের জন্য শুরু হয় চড়-থাপ্পড়-লাথি আর মেরে ফেলার ভয়-ভীতি। তাতেও কাজ না হলে জলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে। লোহার শিক গরম করে গেঁথে দেওয়া হতো দুই পায়ের উরুতে। কাকনের আর্তচিৎকারে উল্লসিত সেনা ও রাজাকারদের নির্যাতনের মাত্রা যেন আরোও বেড়ে যেতো। তবু সহযোদ্ধাদের মুখ আর দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা কাকন বিবিকে সংকল্পে অটল রাখে। ’ছবি: বাংলানিউজপাশ থেকে কথা যোগ করেন মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম বলেন, ‘বেঁচে থাকার তাগিদে পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করার কথা স্বীকার করে কৌশলে মুক্তি পান তিনি। তবে এরপরেও ধরা পড়েছেন বিভিন্ন সময়। কখনো কখনো তথ্য পাওয়ার জন্য তিনি স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন। কিন্তু যতবারই পাক ক্যাম্পে গিয়েছেন, ততবারই শিকার হয়েছেন নির্মম নির্যাতনের। হানাদার পাকসেনা ও রাজাকারেরা তাকে বাঙ্কারে রেখে নির্যাতন করেছে। দেশের স্বার্থে সবকিছু নীরবে সহ্য করে গেছেন এ নারী। অথচ এখন তার খবর রাখে না কেউ। মরতে বসেছেন প্রায় বিনা চিকিৎসায়।

কাকন বিবির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখা যায়, এক পা ও এক হাত অবশ হয়ে পড়ে আছেন। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেন না একা একা। কারো সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হয় তাকে। ঠিক মতো কথাও বলতে পারেন না। আর মুক্তিযুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলেই আতঙ্কে কেঁদে ওঠেন। অথচ এ নারীই গোয়েন্দাগিরির পাশাপাশি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। লক্ষ্মীপুর ক্যাম্পে ৫ নং সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকত আলীর তত্ত্বাবধানে কান্দাগাঁও, মহব্বতপুর, নূরপুর, সিলাইপাড়, দোয়ারাবাজার, টেলাই, তামাবিল, রসরাই, বেনিংগাঁও, টেংরাটিলা ইত্যাদি এলাকায় ২০টির বেশি অপারেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকাকন বিবি বর্তমানে তাঁর নিজ গ্রাম দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের জিরার গাঁওয়ে রয়েছেন। কয়েক মাস আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তার মেয়ে ছকিনা বিবি তাকে নিয়ে সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে দীর্ঘ দুই মাস চিকিৎসা শেষে ফেরেন নিজ বাড়িতে।

কথা হয় কাকন বিবির মেয়ে সখিনার সঙ্গে। বাংলানিউজের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী মাকে বীরপ্রতীক হিসেবে সাময়িক স্বীকৃতি দিলেও এখনো খেতাবটি পূর্ণতা পায়নি। ফলে সরকার বর্তমানে তাকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৩ মাসে ৩০ হাজার টাকা করে ভাতা প্রদান করছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে চিকিৎসার জন্য ঋণ নেওয়া হয়েছিল। সে ঋণ বাবদ এখন মাসে ১৫ হাজার ৫শ টাকা কেটে নেয় ব্যাংক। আমার সংসারের আয় রোজগারও খুব বেশি না। ফলে মায়ের চিকিৎসা করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিষয়টি অবহিত করে কথা হয় দোয়ারাবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীকের সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, কাকন বিবি আমাদরে গর্ব ও অহংকার। তিনি সাময়িকভাবে বীরপ্রতীক খেতাব পেলেও এখন পর্যন্ত এ নিয়ে গেজেট হয়নি। এ নিয়ে আমি স্থানীয়ভাবে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। সকল কাগজপত্র পাঠনো হয়েছে, কিন্ত এখন পর্যন্ত কোনো ফলাফল আসেনি।

তিনি বলেন, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যখন অনুষ্ঠান হয় তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে কাকন বিবির খেতাবের কথা বলেছি। বলেছি যেন পূর্ণাঙ্গভাবে গেজেট আকারে তা প্রকাশ করা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান মানিককেও এ ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছে, যেন কাকান বিবি তার খেতাবটি পান এবং সে অনুযায়ী ভাতা প্রাপ্ত হন। এখন যে আর্থিক সংকট চলছে, সেজন্য উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে যা কিছু করা যায় তা করব।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৭
এইচএমএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।