মৎস্য বিভাগ, কোস্টগার্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রয়োজনীয় তৎপরতা না থাকায় এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় মাছ শিকার চলছে। দাদনদার-মহাজনরা সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে জেলেদের নদীতে পাঠাচ্ছেন, এমন অভিযোগ সবার মুখে মুখে।
লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল চলমান অভিযান নিয়ে অন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কমলনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন। তবুও রাত-দিন নির্বিচারে চলছে মাছ নিধন।
বুধবার (২০ মার্চ) বিকেল থেকে শুক্রবার (২২ মার্চ) সকাল পর্যন্ত কমলনগরের মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা নির্বিঘ্নে মাছ শিকার করছেন। বেশির ভাগ জেলে জাটকা শিকারে ব্যবহার করছেন অবৈধ কারেন্ট জাল। বাঁধা জাল দিয়ে মারছেন ইলিশের পোনা। মশারি জাল দিয়ে নিধন করছেন পোয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা। এসব মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে হাট-বাজার ও আড়তে। সংরক্ষণ করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
কমলনগরের মাতাব্বারহাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, জেলেরা নদীতে কারেন্ট জাল দিয়ে জাটকা ধরার ফাঁদ পেতেছেন। কোস্টগার্ড দেখেও না দেখার ভান করছে। এসময় মৎস্য কর্মকর্তারা লোক দেখানোর জন্য ছোট একটি নৌকা নিয়ে জেলেদের ধাওয়া করলেও জাল জব্দ করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। কিছু সময় পর ওই এলাকা থেকে মৎস্য কর্মকর্তা ও কোস্টগার্ড চলে যাওয়ার পর জেলেরা জাল টেনে মাছ শিকার করে ঘাটে তোলেন। এভাবেই চলেছে ‘মাছ রক্ষার অভিযান’।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ধ্যার পর থেকে মেঘনা নদী থাকে পুরো অরক্ষিত। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে সারা রাত ধরে জেলেরা মাছ শিকার করেন। ভোরে ঘাটের আশপাশের এলাকায় অস্থায়ী ঘাটে জেলেরা মাছ তোলেন। লাখ-লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয় প্রতিদিন। মাছ বিক্রির সময় একটি চক্র জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেয়, ওই টাকায় ম্যানেজ করেন সংশ্লিষ্টদের।
কমলনগরের মেঘনায় নানা কৌশলে ব্যাপকহারে মাছ নিধন চলছে। এছাড়াও লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর ও রামগতিতেও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জেলেরা নদীতে মাছ শিকার করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
চাঁদপুরের ষাটনল এলাকা থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার মাছের অভয়াশ্রম। প্রজনন ক্ষেত্র হওয়ায় এখানে মাছ ডিম ছাড়ে; মাছের পোনা বড় হয়; মাছ বেড়ে উঠে। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস এখানে মাছ ধরায় রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এসময় মেঘনায় জাল ফেললেই জাল ভরে মাছ উঠে। এই সুযোগে অসাধু জেলেরা আইন অমান্য করে মাছ শিকার করেন। দাদনদার-মহাজনদের চাপে জেলেরা বাধ্য হয়ে নদীতে যান। তাছাড়াও মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে জেলেদের সরকারিভাবে যে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার হয় তা যথাসময়ে বিরতরণ না করায় এবং নিবন্ধিত সকল জেলে খাদ্য সহায়তার আওতায় না আসায় মাছ ধরার মহোৎসব চলছে।
কমলনগরের জেলেরা বলছেন, ফেব্রুয়ারি থেকে জেলেদের ভিজিএফ’র চাল বিতরণ করার কথা থাকলেও বিতরণ করা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে জেলে পরিবারগুলোর চরম দুর্দিন কাটছে। বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় সংসার চালাতে তারা নদীতে মাছ শিকারে যায়। কেউ-কেউ বলছেন খাদ্য সহায়তার তালিকায় তাদের নাম নেই; মাছ শিকার না করলে খাবে কি?
কমলনগরের দায়িত্বে থাকা কোস্টগার্ডের কন্টিজেন্ট কমান্ডার মো. হুমায়ুন বলেন, দীর্ঘ নদী এলাকায় অভিযান চালাতে তাদের সেই সক্ষমতা নেই। দ্রুতগতির ইঞ্জিন চালিত ট্রলার কিংবা স্পিডবোট নেই। জেলেরা মাছ ধরার সময় আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। এসময় জাল টেনে তোলাও সম্ভব হয়না। শ্রমিক নিয়োগ করার বাজেট নেই, যে কারণে জাল জব্দ করা যায় না।
কমলনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস বলেন, তাদের জনবলের অভাব রয়েছে। যে কারণে যথাযথভাবে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। তবুও জেলেদের মাছ ধরা থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করা হচ্ছে। খাদ্য সহায়তার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলেদের ভিজিএফ’র চাল বিতরণ করা হবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এইচ এম মহিব উল্লাহ বলেন, লক্ষ্মীপুরে ৪৯ হাজার ৫৫৮ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। তাদের মধ্য থেকে ২৫ হাজার ৯৪৭ জন জেলে খাদ্য সহায়তা পাবেন। বাকি ২৩ হাজার ৬১১ জন জেলে বাদ পড়েছেন। তারাও যাতে খাদ্য সহায়তা পায় এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাটকা রক্ষায় মার্চ-এপ্রিল দুই মাস লক্ষ্মীপুরের রামগতি থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরা ওপর নিষেধাজ্ঞা জরি করা হয়েছে। এসময় মাছ ধরা, পরিবহন, বাজারজাত ও সংরক্ষণ অন্যায়। এ আইন অমান্য করলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৯
এসআর/জেডএস