ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা তিনশ’ চাতাল মিলের অধিকাংশ শ্রমিক দাদন নিয়ে সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে না পেরে বছরের পর বছর চাতালেই অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। কাজ অনুযায়ী সঠিক পারিশ্রমিকও পাচ্ছেন না তারা।
সরেজমিন বিভিন্ন চাতাল মিল ঘুরে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধান সিদ্ধ করা মাঠে শুকানো এবং তা থেকে চাল তৈরি সব কাজই করে যাচ্ছেন শ্রমিকরা।
তাদের দাবি পরিশ্রম অনুযায়ী তাদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য তো রয়েছেই। নারীরা পুরুষের সমান কাজ করলেও পারিশ্রমিক পায় পুরুষের তুলনায় অনেক কম। যেখানে একজন পুরুষ প্রতিদিন তিনশ’ টাকা পায় সেখানে একজন নারী পায় মাত্র ষাট টাকা।
জানা যায়, এসব চাতাল শ্রমিকরা জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে আসেন। কেউ ঋণের দায় মাথায় নিয়ে কেউবা সংসারে অভাব অনটন ও নদী ভাঙনে সহায় সম্বল হারিয়ে।
মালিকদের কাছ থেকে এককালীন দাদন নেয়ার পর যে বেতন পান তা দিয়ে দাদনের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের।
কথা হয় হবিগঞ্জের লাখাই থেকে আসা চাতাল শ্রমিক শফিক মিয়ার সঙ্গে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মিলে আসার সময় মালিক আমাদের ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা দাদন দেন। আমাদের সম্পূর্ণ কাজ প্রোডাকশনের ওপরে। প্রতি বস্তা ধান শুকানো থেকে শুরু করে ডেলিভারি পর্যন্ত ১৮ টাকা দেয়া হয় আমাদের। আমরা ১০/১৫ জন শ্রমিক একটি মাঠগেইলে কাজ করতে দুই/তিন দিন সময় লাগে। তাতে দৈনিক জন প্রতি তিনশত টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে আমাদের বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও অগ্রিম দাদন নেয়ায় ইচ্ছা করলেও আমরা পরিবারের কাছে যেতে পারি না। দাদন পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাদের কাছে বন্দি থাকতে হয়।
কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে আসা চাতাল শ্রমিক সিদ্দিক মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, এক লাখ টাকার দাদনে বছরে ২০ হাজার টাকা কাটে। রয়ে যায় ৮০ হাজার টাকা। এ গুলো বছরে বছরে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু মালিকরা যে টাকা বেতন দেন তা দিয়ে দাদনের ঋণ পরিশোধ করতে পারি না।
নারী শ্রমিক লিমা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রৌদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যে পরিশ্রম করি সে অনুযায়ী আমাদের বেতন পোষায় না। অথচ পুরুষদের থেকে আমাদের কষ্ট বেশি। কিন্তু পুরুষদের তুলনায় আমরা পারিশ্রমিক পাচ্ছি কম। আমরা নারীরা শ্রম বৈষ্যমের শিকার হচ্ছি।
শ্রমিক রুসুল মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, কিছু দিন আগে দাদনের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে এক শ্রমিক পালিয়ে যান। পরে মিলের সর্দার রাতের মধ্যেই সেই শ্রমিককে খুঁজে ধরে এনে একটি ঘরে বন্দি করে রাখেন। পরে কিনি অপমান সইতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপরও আমাদের পেটের দায়ে এ কাজ করতে হয়।
আশুগঞ্জ চাতাল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হরমোজ আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দুই বছর আগে সব শ্রমিকদের নিয়ে দাবি দাওয়া, বেতন মজুরি বাড়ানো জন্য আন্দোলন করেছিলাম। তারপরে ২/ ৩ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। তবে মিলের মালিক হুশিয়ারি করে দিয়ে বলেন, আমাদের দাদন দিয়ে দাও। কারণ অল্প বেতনে দাদন পরিশোধ করা সম্ভব না। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমাদের মজুরি যেন বাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
চাতাল কল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ বাংলানিউজকে বলেন, চাতাল শিল্প একটা বড় শিল্প হলেও আমরা নীতিগতভাবে তাদের সম্পূর্ণ অধিকার দিতে পারি নাই।
শ্রম আইন প্রয়োগ করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাস্তবতার নিরিক্ষে তা প্রয়োগ করা সম্ভব না। তাদের সুযোগ সুবিধার জন্য আমরা সব মালিকদের নিয়ে বসে চেষ্টা করব।
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজিমুল হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা যে বিষয়টা জানতে পেরেছি শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য এবং মজুরি নিধারণ করা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। শ্রমিকদের আটকে রেখে নির্যাতনের বিষয়টি আমাদের নজরে এলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। এখানে একটি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র আছে তাদের সঙ্গে কথা বলে শ্রম আইন যাতে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় আমরা চেষ্টা করব।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৯
আরএ