ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বিষমুক্ত আম রপ্তানিতে বড় ধাক্কা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫১ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৯
বিষমুক্ত আম রপ্তানিতে বড় ধাক্কা গাছে ঝুলছে আম। ছবি: বাংলানিউজ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: বিষমুক্ত আম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চাষিরা। ঢিমেতালে রপ্তানি শুরুও হয়েছিল, আশার পালে লাগছিলো হাওয়া। কিন্তু, এখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। ক্ষতির বোঝা বইতে বইতে আম রপ্তানির মাধ্যমে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় আকাশ কুসুম কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০১৫ সাল থেকে ইউরোপে ব্যক্তি পর্যায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিষমুক্ত আম রপ্তানি শুরু হয়। এরপর চাষিরা আশা করেছিলেন রপ্তানি প্রতি বছর বাড়বে।

এ আশায় চাষের ক্ষেত্রে ফ্রুট ব্যাগিংসহ আমদানিকারকদের বিভিন্ন শর্ত পূরণ করেছেন চাষিরা।  

রপ্তানির উদ্দেশ্যে এ বছর প্রায় ১০ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৫ মেট্রিক টন বিষমুক্ত রপ্তানি হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে আরো ৬০ হাজার মে. টন। কিন্তু প্রত্যাশামতো রপ্তানি আদেশ না পাওয়ায় হতাশা হয়ে পড়েছেন চাষিরা। এতো কষ্ট এবং খরচের পরও প্রত্যাশা অনুযায়ী আম রপ্তানি করতে না পারায় বইতে হচ্ছে ক্ষতির বোঝা।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানায়, আমদানিকারকদের শর্ত পূরণের নিমিত্তে বিষমুক্ত আম উৎপাদনের জন্য জেলায় প্রায় ১০ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়। যারা বিষমুক্ত আম উৎপাদন করছেন তাদের উৎপাদন বাড়ছে না। অন্যদিকে গত ৩ বছরে আম রপ্তানি কমতির দিকে। এতে বিষমুক্ত আম উৎপাদন এবং রপ্তানি নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন চাষিরা। কীটনাশক ও ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে আম ব্যাগে করছেন এক চাষি।  ছবি বাংলানিউজ জেলার শিবগঞ্জ পৌর এলাকার আম চাষি ইসমাঈল হোসেন শামিম বাংলানিউজকে জানান, ২০১৫ সালে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রথম তিনিই ইউরোপে আম রপ্তানি শুরু করেন। পরে আশা করেছিলেন রপ্তানি বাড়বে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় নিরাপদ আম রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

শিবগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথপুরের আমচাষি আওয়াল বাংলানিউজকে জানান, কন্টাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে যে আম রপ্তানির নিয়ম প্রচলিত আছে তা নিরাপদ আম উৎপাদক ও রপ্তানি আদেশদানকারী দু’টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লিখিত একটা সাদা কাগজের চুক্তি। এর আইনি ভিত্তি বা জবাবদিহিতা না থাকায় রপ্তানি আদেশদাতারা ইচ্ছে করলেই যে কোনো সময় আদেশ বাতিল করে। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জেলার সাতজন কৃষকের মাধ্যমে ১০৪, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে একজন কৃষকের মাধ্যমে পৌনে তিন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০ জন কৃষকের মাধ্যমে ৩৩ এবং চলতি বছরে মাত্র পাঁচ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, জেলায় এবার প্রায় ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। কয়েকবছর আগেও মাছি পোকার (ফ্রুট ফ্লাই) আক্রমণ থেকে আম রক্ষা করতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হতো। এতে পরিবেশের ক্ষতি যেমন হতো পাশাপাশি আমের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছিলো। আর মাছি পোকায় আক্রান্ত আম বিদেশেও রপ্তানি করা যেত না। এ অবস্থায় মাছি পোকার আক্রমণ থেকে আম রক্ষায় পাঁচ বছর আগে ফ্রুট ব্যাগিং নিয়ে কাজ শুরু করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যাগিং করা আমে কোনো ধরনের দাগ থাকবে না। এর মাধ্যমে সবধরনের রোগও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে আমকে রক্ষা করে বিষমুক্ত আম উৎপাদন করা যায়। এরপর থেকে জেলার কৃষকরা বিদেশে আম রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। শিবগঞ্জ উপজেলায় রপ্তানির জন্য নিরাপদ আম উৎপাদনের একটি আদর্শ আম বাগান।  ছবি: বাংলানিউজফল গবেষক ড. সরফ উদ্দিন জানান, রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ থেকে আম রক্ষায় গত ৫ বছর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু হয়েছে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির ব্যবহার। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে বিষমুক্ত আম উৎপাদন হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ইউরোপভুক্ত দেশগুলোতে আম রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ধারাবাহিকতায় ওয়ালমার্টসহ বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ব্যাগিং করা ল্যাংড়া, খিরসাপাত, বারি আম-২, বারি আম-৩, ফজলি ও আশ্বিণা জাতের দেড়শ মেট্রিক টন আম পাঠায় বিদেশে। কিন্তু গত বছর নানা জটিলতার কারণে আম বিদেশে রপ্তানি হয়নি। অথচ রপ্তানির আশায় নিরাপদ আম উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন আম চাষিরা।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানায়, এ বছর ১০ কোটিরও বেশি আমে ব্যাগিং করা হয়েছে। জেলার শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, সদর ও গোমস্তাপুর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা, মহারাজপুর, রাণীহাটি, চককীত্তি, কানসাট, ধাইনগর এলাকায় ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ফজলি ও আশ্বিণা জাতের আম বেশি।

চককীর্ত্তির নিরাপদ আম উৎপাদনকারী চাষি কবির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, তিনি এ বছর ২৫ হাজার আম ব্যাগিং করেছেন। কিন্তু এখনও অর্ডার না পাওয়ায় হতাশ। বিদেশে রপ্তানির সব শর্ত পূরণ করতে গিয়ে তার উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে অনেক। সে অনুযায়ী স্থানীয় বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে তাকে আম বিক্রি করতে হবে। কিন্তু রপ্তানির অপেক্ষায় না থেকে গতবছরের মতো লোকসানে স্থানীয় বাজারে আম বিক্রি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

আমচাষি ফজলুল হক বাংলানিউজকে জানান, তিনি ২০১৭ সালে রপ্তানিযোগ্য ৩০ টন আম উৎপাদন করে মাত্র ১ টন, ২০১৮ সালে ৫০ টনে ৪ এবং চলতি বছর ২০ টন আম উৎপাদন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো রপ্তানি আদেশ পাননি।  

শিবগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তা এস এম আমিনুজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে ৫ মেট্রিক টন আম ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে। স্থানীয় বাজারেই ব্যাগিং করা আমের দাম চড়া হওয়ায় আমদানিকারকরা কিছুটা হতাশ।

বাংলাদেশ ম্যাংগো প্রডিউসার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ বাংলানিউজকে জানান, সারা দেশেই আমের উৎপাদন বেড়েছে। এতে করে আমের নায্যমূল্য নিশ্চিত হচ্ছে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিবছরই বিষমুক্ত রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে রপ্তানি বাড়ছে না। এ জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ পরিচালক আম রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়ে বলেন, যদি রাষ্ট্র রপ্তানির পরিবেশ তৈরি করতে পারে তবে আম রপ্তানি বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০১৯
এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।