শুক্রবার (৩০ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। যাতে অংশ নিয়েছেন গুম হওয়া অনেকের পরিবারের সদস্যরা।
সাতক্ষীরা জেলার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কুখরালি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাশেদ। ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট রাত ৯টায় তার ছেলে ডাক্তার শেখ মোখলেছুর রহমান জনিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করেন। এর পরের কিছুদিন ছেলের খবর জানলেও পরবর্তীতে আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
সভায় আব্দুর রাশেদ বলেন, আমার ছেলেকে গ্রেফতারের পর সাতক্ষীরার কারাগারে রাখা হয়। আমি আর আমার ছেলে বউ সাতক্ষীরার কারাগারে দেখা করতে যাই। সেসময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাকে বলেন, তোর ছেলেকে যা বলি তা স্বীকার করতে বল। আমি আমার ছেলেকে বলি, বাবা তুমি যা জানো সব সত্য কথাই বলো। তখন পুলিশ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে পিস্তল দেখিয়ে বের করে দেয়।
‘এরপর থেকে ছেলের আর কোনো খোঁজ-খবর পাইনি। কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই জানিনা। এখনও আমাকে ও আমার পরিবারকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আমার ছেলে তার সন্তানের মুখও দেখতে পারেনি। তাই আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আমার ছেলেকে যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সে যেন তার সন্তানের মুখটা অন্তত দেখতে পারে। ’
তিনি বলেন, আমার ছেলে তো কোনো রাজনৈতিক দল করতো না। আমার ছেলে কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসীও ছিল না। আমার ছেলে ডাক্তার। তার একটাই অপরাধ, সে গরিব, দুঃখী, অসহায় ও মেহনতি মানুষের চিকিৎসা করে বেড়াত। আমার ছেলেকে তো গুম করা হয়েছে-ই, একইসঙ্গে তার মামলাটিও গুম করা হয়েছে।
আলোচনা সভায় উল্লেখ করা হয়, প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে গুমের শিকার হওয়া ৫০৭ জনের মধ্যে ৬২ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত ১৫৯ জনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালে দৈনিক গড়ে ৮ জন মানুষ গুম হয়েছে। আর এ বছরের প্রথম তিন মাসে গুম হয়েছে ১২ জন।
বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন- গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ও প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, ঢাবির অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়াসহ আরও অনেকেই।
বক্তারা বলেন, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর অন্যতম ভুক্তভোগী হচ্ছেন নারী, শিশু ও প্রবীণ বাবা-মা। বহুবার এসব পরিবারের ফরিয়াদ ও আকুল আবেদন আমরা শুনেছি। আমরা অনতিবিলম্বে অপহরণ ও গুমের অবসান ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করছি।
তারা বলেন, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্ত্রীরা জানেনা তারা কি বিধবা নাকি সধবা! তারা জানে না যে, তাদের স্বামী বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। ওইসব ব্যক্তিদের সন্তানেরা জানে না তাদের বাবা মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে। মারা গেলে তাদের প্রিয়তম বাবার কবরটি কোথায়, তাও জানেনা তারা।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এখানে যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কিংবা গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা থাকেন, তাহলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর অনুরোধ করছি। কারণ স্বজন হারানোর বেদনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে কেউ বেশি ভালো বুঝবে না।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এখানে এতগুলো মানুষ প্রিয়জনের ছবি বুকে নিয়ে বসে আছে। স্বজন হারানো ব্যক্তিদের দাবির কথা চিন্তা করে একটি কমিশন গঠন করে তদন্ত করে দেখুন। যারা এখানে ছবি হাতে বসে আছে, তারা কি মিথ্যা বলছে? তদন্ত করে সত্য প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করুন।
আলোচনা সভায় বিভিন্ন সময় গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন। প্রিয়জনকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান এই ব্যক্তিরা গুমের শিকার হওয়া তাদের প্রিয় মানুষটির ছবি বুকে নিয়ে আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৯
আরকেআর/এসএ