ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বালুখেকোদের কবলে পুনর্ভবা, হুমকির মুখে বাঙ্গিবেচা ব্রিজ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৯
বালুখেকোদের কবলে পুনর্ভবা, হুমকির মুখে বাঙ্গিবেচা ব্রিজ বাঙ্গিবেচা ব্রিজ। ছবি: বাংলানিউজ

দিনাজপুর: বালুখেকোদের কবলে পড়েছে দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদী। ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে শহরের বাঙ্গিবেচা ব্রিজ। বালু উত্তোলনের কারণে ব্রিজের পিলারের কাছে সৃষ্টি হয়েছে ১০ ফুট আকারের গর্ত। ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছে ব্রিজের মাটির নিচের পিলার। বেরিয়ে এসেছে লোহার রড।

বিগত ৪ বছরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে সৃষ্ট গর্তে পড়ে মৃত্যু হয়েছে নয় শিশু, কিশোর ও বয়স্ক ব্যক্তির। এছাড়া প্রভাবশালী বালুখেকোদের কারণে নদীতে মাছ শিকারেও যেতে পারছেন না জেলেরা।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী, সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে ড্রেজার মেশিন বা অন্যান্য যন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করা যাবে না। অথচ দিনাজপুরের পুনর্ভবা (কাঞ্চন) নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ব্রিজের কাছ থেকে তোলা হচ্ছে বালু। দিনাজপুর শহরের মাঝাডাঙ্গা এলাকাস্থ বাঙ্গিবেচা ব্রিজের কাছ দিয়ে দুইটি বড় ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে ব্রিজটি।

সরেজমিনে বাঙ্গিবেচা ব্রিজে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রিজে রয়েছে মোট ছয়টি পিলার। যার মধ্যে চারটি পিলারই ঝুঁকিতে। সাধারণত ব্রিজ নির্মাণ করা হয় তিন ধাপে। যার মধ্যে প্রথমধাপে মাটির নিচ থেকে পিলার ঢালাই দিয়ে লেভেলে আনা হয়। এরপর ঢালাই দেওয়া হয় বেইজম্যান্টের। শেষ ধাপে ওঠে ব্রিজের মূল পিলার। যেখানে মাটির নিচের পিলারগুলো সাধারণত দৃশ্যমান হওয়ার কথা না। কিন্তু বাঙ্গিবেচা ব্রিজের দৃশ্য উল্টো ধরনের। ঝুঁকিতে ব্রিজের পিলার।  বালুখেকোদের কবলে পড়ে যেই পিলার মাটির নিচে থাকার কথা, সেই পিলার প্রায় ১০ ফিটের মতো দেখা যাচ্ছে মাটির উপরে। ব্রিজের পিলারের নিচে বালু সরে যাওয়ায় মাটির নিচের পিলারে দেখা দিয়েছে ফাটল। এছাড়া অনেক জায়গায় ভেঙ্গে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে ভেতরে থাকা লোহার রড। অন্যান্য ব্রিজের ওপর দিয়ে কোনো বড় ধরনের গাড়ি গেলে ব্রিজটি ঝাঁকুনি খায়। কিন্তু বাঙ্গিবেচা ব্রিজের ওপর দিয়ে সামান্য একটি ইজিবাইক গেলেও ব্রিজটিতে তীব্র ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়।

সম্প্রতি বালুখেকোদের হাত থেকে বাঙ্গিবেচা ব্রিজকে রক্ষা করতে একত্রিত হয়েছেন ব্রিজের ওপর দিয়ে চলাচল করা ১৩টি গ্রামের হাজারো মানুষ। গঠন করা হয়েছে ব্রিজ রক্ষা কমিটি। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুইহারি-মাঝাডাঙ্গা ব্রিজ রক্ষা কমিটি’। এই কমিটিতে রয়েছে ১৩টি মহল্লা।

এছাড়াও ব্রিজের বিপরীত পাশে গড়ে উঠেছে সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বসতি। যেটি দেশের সর্ববৃহৎ ‘মানবপল্লী’ হিসেবে পরিচিত। নদীর পাশে মানবপল্লীটি অবস্থান হওয়ায় তারাও রয়েছে চরম দুশ্চিন্তায়।

বাঙ্গিবেচা ব্রিজের বিপরীত পাশে গড়ে ওঠা মানবপল্লীর বাসিন্দা সোহাগ বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ঘর যেকোনো সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। আমরা চরম দুশ্চিন্তায় আছি। জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের প্রচেষ্টায় এখানে আমাদের এই মানবপল্লী গড়ে উঠেছে। আমাদের মানবপল্লী পুনর্ভবা নদীর তীরবর্তী জায়গায় গড়ে উঠেছে। ব্রিজের কাছে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে আমাদের বসতির তীরের বালু ধসে পড়ছে। যার কারণে নদীতে একটু বেশি পানি হলেই আমাদের এই বসতি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে পড়বে।

কমিটির মধ্যে থাকা ১৩ গ্রামের বাসিন্দারা বাংলানিউজকে বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্তে পড়ে বিগত চার বছরে নয় শিশু, কিশোর ও বয়স্ক ব্যক্তির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বালু উত্তোলনকারীরা এতই শক্তিশালী যে, তারা আমাদের কোনো কথাই শোনে না। আমরা প্রতিবাদ করলে তারা আমাদের হুমকি দেয় যে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ব্রিজ পার হতে দেবে না। দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করতে দেবে না। ব্রিজের পিলারে ভেতরে থাকা লোহার রড বের হয়ে আছে। ‘অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর মাঝখানে সৃষ্টি হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ ফুটের গর্ত। এই গর্তে যে কেউ পড়লে আর উঠতে পারবে না। আমরা তাদের অনেকবার নিষেধ করেছি। তারা আমাদের কথায় কোনো কর্ণপাত করেনি। বরং তারা আমাদেরকে ব্রিজ পার হতে দেবে না বলে হুমকি দেয়। এছাড়াও তারা বলে, এ ব্যাপারে বেশি বাড়াবাড়ি করলে পা কেটে দেওয়া হবে। ’

ব্রিজ রক্ষা কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বাঙ্গিবেচা ব্রিজের কাছে শহরের লালবাগ এলাকার বাসিন্দা মো. মাহফুজ আলম দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। দিনাজপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার ছত্রছায়ায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মাহফুজ। এই ব্রিজের ওপর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এছাড়াও কয়েক হাজার ছোট-বড় যানবাহন চলাচল করে। এই ব্রিজটির ওপর দিয়ে পাশ্ববর্তী বোচাগঞ্জ ও কাহারোল উপজেলায় মানুষ সহজে যাতায়াত করতে পারে। অথচ আজ বালুখেকোদের কারণে ব্রিজটি হুমকির মুখে পড়েছে।

তারা বলেন, বালুখেকোরা সম্প্রতি ১৩টি গ্রামের সব মসজিদে তিন লাখ টাকা করে ঘুষ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছি। তারা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমাদের আন্দোলনের ফলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। তবে যেকোনো সময় তারা আবারও বালু উত্তোলন শুরু করতে পারে। প্রশাসনের কাছে আমাদের একটাই দাবি, এই বাঙ্গিবেচা ব্রিজটি রক্ষা করতে হবে।

আগামী ৮ নভেম্বর কমিটিতে থাকা ১৩টি গ্রামের সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে বালুখেকোদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলেও জানান তারা।

এলাকার মৎস্যজীবী মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নদীতে ঠিকমতো মাছ শিকার করতে পারি না। তারা আমাদেরকে নদীতে নামতে দেয় না। আমরা মাছ শিকার করতে গেলে তারা আমাদের গায়ে হাত দেয়। আমরা ভয়ে মাছ শিকার করতে পারছি না।

এব্যাপারে দিনাজপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খলিলুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ব্যাপারে ইতোপূর্বে আমরা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। আমাদের একটি টিম খুব শিগগিরই বাঙ্গিবেচা ব্রিজের সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে যাবে। তারা আমাকে রিপোর্ট দিলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫, নভেম্বর ০৬, ২০১৯
এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।