গ্রাম্য বাজারের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গরম চিতই পিঠা খাবার নিত্য এই দৃশ্য চোখে পড়ে শীতের সন্ধ্যায়। চরাঞ্চলে গড়ে উঠা জনপদের ইট বিছানো আধাপাকা রাস্তার পাশে বসে পিঠা বিক্রি করতে দেখা গেছে শাহানা নামে এক অল্পবয়সী নারীকে।
শিবচর উপজেলার কোল ঘেঁষে আড়িয়াল খাঁ নদের চরে গড়ে উঠা জনপদ সদরপুর উপজেলার চরমানাইর ইউনিয়নের মুন্সিগ্রাম। সবুজে ঘেরা চরাঞ্চলে জীবিকার অন্যতম উৎস কৃষিকাজ-পশুপালন। এছাড়া মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন চরের দরিদ্র মানুষেরা। পুরো চরাঞ্চলে নেই কোনো বাজার বা হাট। সড়ক পথে শিবচর উপজেলার সূর্যনগর বাজারই এই চরের মানুষের একমাত্র ভরসা। তবে দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার। মুন্সিগ্রাম-সূর্যনগর সড়কের পাশে বসে শাহানা নামে এই নারী চিতই পিঠা বানিয়ে বিক্রি করছেন। আগ্রহ নিয়ে সেই পিঠা খাচ্ছেন স্থানীয়রা।
আশেপাশে কোনো বাজার না থাকলেও শাহানার পিঠার ছোট্ট দোকানকে ঘিরে বেশ ভিড় জমে উঠেছে। আয়েশ করে পিঠা খাচ্ছে চরাঞ্চলের মানুষেরা। মাত্র দুইদিন আগে গড়ে উঠা দোকানকে ঘিরে ক্রেতাদের আগ্রহের যেন শেষ নেই। শীতের সন্ধ্যায় হাতের কাছে গরম চিতই পিঠা পেয়ে বেশ আনন্দিত তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চুপচাপ একমনে পিঠা তৈরি করে যাচ্ছেন শাহানা। কেউ খাচ্ছে আবার কেউ অপেক্ষায় রয়েছে। বাজারহীন অনেকটা নির্জন পরিবেশে গ্রাম্য রাস্তার পাশে বসে পিঠা তৈরি করা নিয়ে আলাপ করলে স্থানীয়রা জানান, কিছু টাকা-পয়সা রোজগারের আশায় পিঠার দোকান দিয়ে বসেছে সে। কাছেই তার বাড়ি। স্বামীর স্বল্প উপার্জনে পরিবারের ভরণ-পোষণ হচ্ছে না। আর একারণেই পিঠা বিক্রি করে সংসারের অভাব ঘোচানোর চেষ্টা তার।
স্থানীয়রা আরও জানান, মাত্র শীতের শুরু। শাহানার এই পিঠার দোকান এখনই বেশ জমে উঠেছে। অনেকেই বিকেলে এই চরে ঘুরতে আসে। নদীর পাড়ে বসে সময় কাটায়। তারা এখানে এসে পিঠা খায়। ফলে ভালো বিক্রি হয়।
পিঠা বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইতে শাহানা বাংলানিউজকে বলেন, আড়িয়াল খাঁ নদীতে আমার ঘর পাঁচবার ভেঙেছে। এখন মুন্সিগ্রামে এই চরে থাকি। স্বামী আবুল উকিল ঢাকায় রিকশা চালায়। রোজগার কম। বাড়িতে কখনো টাকা দেয়, আবার কয়েকমাস কোনো খোঁজ থাকে না। ছন্নছাড়া স্বভাব তার। তাই পিঠা বিক্রি করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছি। আর পিঠা তৈরির কাজটি সহজ।
তিনি জানান, এক ছেলে আর এক মেয়ে তার। সংসারের অভাবে ছেলেকে শিবচরের পাঁচ্চর এলাকায় একটি মোটর মেরামতের দোকানে দিয়েছেন। আর মেয়েটি পড়ছে চরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে। নুন আনতে পানতা ফুরায় তার। তাই বিকেল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত রাস্তার পাশে বসে পিঠা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, প্রথম দিন মাত্র দেড় কেজি পরিমাণ চালের গুড়া নিয়ে পিঠা তৈরি করেন। মুহূর্তেই সব বিক্রি হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিনে আড়াই কেজি পরিমাণ চালের গুড়া তৈরি করেছেন। তাও শেষ। বেশ সাড়া মিলেছে তার পিঠার। শীতের পুরো সময় তিনি পিঠা বিক্রি করবেন।
ভ্যানচালক ইসহাক মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, সন্ধ্যায় সস্তায় পেট ভরতে এই পিঠার বিকল্প নাই। এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় পিঠা খেয়ে যাই। পাঁচ টাকা করে একটা পিঠা। সঙ্গে মরিচ, ধনিয়া পাতা আর সরিষা ভর্তা।
এক যুবক বলেন, বিকেলে ঘুরতে এসেছি এখানে। বিকেলে চরাঞ্চলের রাস্তায় হাটতে বেশ ভালো লাগে। সন্ধ্যায় পিঠা বিক্রি করছে দেখে খেতে এসেছি। শীতের সময়টাতে এই পিঠা বেশ জনপ্রিয়।
শাহানার বৃদ্ধ বাবা ইনসান সর্দার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গরীব মানুষ। মেয়েটার দুই সন্তান। মেয়ে জামাই ঠিকমতো টাকা-পয়সা দেয় না। খোঁজ-খবরও রাখে না। বাড়ির পাশে বসে মেয়েটি পিঠা বিক্রি শুরু করেছে। পিঠা বিক্রির সময় আমি বসে থাকি পাশে। এখানে বাজার নাই। রাস্তা দিয়ে লোকজন যারা যায়-আসে, তারাই পিঠা খায়। ভালোই বিক্রি হয়। মেয়ের আশা জাগছে। এখন দুইটা চুলা, সামনে আরও চুলা বানাবে।
অনেকটা প্রত্যন্ত জনপদ। নদীর চরে গড়ে উঠা জনবসতি। যোগাযোগের জন্য সদ্য নির্মিত একটি ইট বিছানো সড়ক। মরা নদীতে চরের সঙ্গে যোগাযোগের নতুন মাত্রা যোগ করেছে নতুন নির্মিত সেতু। সবুজে ঘেরা এই চরাঞ্চলে বিকেলের সময়টা কাটাতে আসেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি রাস্তার পাশে চিতই পিঠার এই দোকান পেয়ে অনেকেই কিছুটা আনন্দিত। হালকা খিদে মেটানোর একটা ব্যবস্থা যেন। আর জনসাধারণের এই হালকা খিদে মেটানোর আড়ালেই এক দরিদ্র নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন, উপার্জনের স্বপ্ন। যাতে করে দরিদ্র সংসারে কিছুটা হলেও স্বচ্ছলতা আসে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০০, ২০১৯
এসএ/