প্রকৃতিতে শীতের আগমনে বেশ কিছুদিন ধরেই শুরু হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ। প্রতি বছরের মতোই কার্তিক মাস (অক্টোবর-নভেম্বর) থেকে রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজ চলছে।
চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতে মাটির ভাঁড়ে রাতভর রস সংগ্রহ করা হয়। ভোরের সূর্য ওঠার আগে গাছিরা রসভর্তি মাটির ভাঁড় গাছ থেকে নামিয়ে পরে মাটির হাঁড়িতে কিংবা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বাল দিয়ে গুড়-পাটালি ও লালি তৈরি করেন। নতুন খেজুর রসের গুড়-পাটালি তৈরির পর তা চলে যাচ্ছে বাজারে। রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি ও বাজারে বিক্রি করতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন গাছিরা।
গ্রামের ঘরে ঘরে খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, গুড়ের মুড়ি-মুড়কি ও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়েছে। বাজারে চিনির দাম তুলনামূলক কম হলেও পাটালি গুড়ের চাহিদা কমেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় গাছিরা।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) বগুড়া কাহালু উপজেলায় দূর্গাপুর ইউনিয়নের পাতঞ্জ গ্রামে চোখে পড়ে পাটালি গুড় তৈরিতে গাছিদের ব্যস্ততা।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আরপাড়া গ্রামের মহররম আলীর ছেলে গাছি মো. মিন্টু আলী (৪৭) পাটালি গুড় তৈরির কাজে চলে এসেছেন বগুড়ায়। একই গ্রামের ফজলু, আফতুন ও দিলশান আলীকে নিয়ে মিন্টু মিয়ার একটি দল গুড় তৈরির কাজ করে আসছেন নিয়মিতভাবে।
জানা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের মোট ২শ’ ২০টি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে, তা থেকে পাটালি গুড় ও স্থানীয় ভাষায় লালিগুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। রস উৎপন্ন করতে গাছের পরিচর্যায় প্রচুর সময় লাগে, তাই সব মিলিয়ে চার মাস তাদের বগুড়ায় থাকতে হয়।
গাছি মিন্টু আলী বাংলানিউজকে জানান, বিগত পাঁচ বছর ধরে তিনি বগুড়া কাহালু উপজেলায় নিয়মিত আসেন খেজুর রস থেকে গুড় তৈরির কাজে। এটিই তার ব্যবসা।
তিনি বলেন, আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে গাছের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করা হয়। এ বছর মোট ২শ’ ২০টি গাছ রস উপযোগী করেছেন তারা। প্রস্তুত করা প্রতিটি গাছ থেকে সপ্তাহে দুই-তিনদিন রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছ থেকে শুরুতে এক থেকে দুই কেজি করে রস সংগ্রহ হয় ও আস্তে আস্তে তা বাড়ে। প্রতিদিন ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ গাছের রস সংগ্রহ করেন তারা।
তিনি আরও বলেন, শুরুর পর প্রথমদিকে প্রতিদিন আনুমানিক পাঁচ কেজি করে পাটালি গুড় তৈরি হয়। তারপর মাঝামাঝি থেকে পুরো মৌসুমে প্রতিদিন ৫০ কেজি থেকে ১২০ কেজি পাটালি ও লালি তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি পাটালি ও লালিগুড় বাজারে পাইকারদের কাছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
গাছ মালিকদের বিষয়ে জানতে চাইলে মিন্টু আলী জানান, রস থেকে গুড় তৈরির জন্য স্থানীয়দের মোট ২শ’ ১০টি গাছের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করা আছে। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তির একটি, দু’টি, পাঁচটি বা ১৫-২০টি আবার কারো ২০-৩০টি করে গাছ রয়েছে। তাদের মৌসুমে প্রতিটি গাছের জন্য ১৬০-২০০ টাকা বা দেড় থেকে দু’কেজি গুড় দিতে হয়।
দিলশান আলী সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খেজুর গাছ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর থেকেই মূলত রস নামানোর পর্ব শুরু হয়। গাছের মাথার নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের বানানো দু’টি চোখা খুঁটি পোঁতা হয়। সঙ্গে দড়ি বা সুতা বেঁধে মাটির পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পাত্রের ভেতর রস পড়ার জন্য বাঁশের তৈরি নালার মতো ভিন্ন একটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয় সেই গাছের সঙ্গে। এভাবেই গাছির নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে খেজুর রস।
তিনি বলেন, দুপুরের পর থেকে তারা চারজন নির্দিষ্ট গাছগুলোতে উঠে তাতে হাঁড়ি ঝুলিয়ে আসেন। এরপর দিনগত রাত ৩টার দিকে, তারা ঘুম থেকে ওঠে গাছ থেকে রস নামানোর প্রস্তুতি নেন। ভোর হতেই সব গাছের রস সংগ্রহ করে তা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি ও লালি তৈরির কাজে নেমে পড়েন।
গুড় তৈরির জন্য শুরুতে টিনের তাওয়াতে রস নামিয়ে আগুনে তাপানো হয়। এসময় তাওয়াতে থাকা রস অনবরত নাড়তে হয়। তারা জ্বালানি হিসেবে খড় ব্যবহার করেন। রস জ্বালের ঘণ্টাখানেক পর রস ঘন হয়। এরপর তা নামিয়ে একটি গোলাকার হাড়িতে ঢেলে বাঁশের একটি সরু লাঠি দিয়ে ঘোরানো হয়। এক পর্যায়ে সেগুলোর ঘনত্ব আরও বেশি হয় এবং তা কাঠের তৈরি চারকোনা বিশিষ্ট খোপের মধ্যে ঢেলে পাটালি আকার দেওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়।
মিন্টু আলী জানান, ব্যবসা আগের মতো নেই। আগেই পাইকারদের থেকে টাকা ধার নিতে হয়। তাই, গুড়গুলো পাইকারদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। ফলে, তেমন লাভবান হওয়া যায় না।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৯
কেইউএ/এবি/এফএম